দিল্লির সুলতানি যুগের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ভারতবর্ষে নতুন নতুন নগরের সূচনা। স্বভাবতই শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নগরায়নের সূচনা খুবই ইঙ্গিতবাহী। টুকরো টুকরো খবর ছাড়া অর্থনৈতিক জীবনের বিশদ কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে সে যুগের অকৃষি তথা শিল্প উৎপাদনের একটা মোটামুটি বিবরণ দেওয়া যায়।
ধাতু উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সমকালীন সাহিত্যে Salt Range এর কথা পাওয়া যায় গেলেও প্রধান নুনের উৎস ছিল সম্ভর হ্রদ। লোহার আকর উত্তোলনের ক্ষেত্রে গভীর খনি খোঁড়ার প্রয়োগবিদ্যা সে যুগে জানা ছিল না। গোয়ালিয়রের পাহাড় থেকে দক্ষিণ ভারতের শেষ পর্যন্ত অনেক লোহা খনি ছিল। কচ্ছের লোহা থেকে তলোয়ার তৈরি হতো। রাজস্থান থেকে তামা পাওয়া যেত। তখন সোনা রুপার উৎপাদন কমেছিল। মনে হয় কর্নাটকের সোনার খনি নিঃশেষ হয়ে আসছিল। হিমালয় থেকে আসা কয়েকটি নদীর পাড়ে বালিতে সোনা পাওয়া যেত। মার্কো পোলো দাক্ষিণাত্য হীরার খনির কথা বলেছেন। তিনি তুতিকোরিনে মুক্তা পাওয়ার কথা বলেছেন
সে যুগের প্রধান শিল্প ছিল বস্ত্র শিল্প। ঐতিহাসিক Lean White দেখলেন এ যুগে চরকার সাহায্যে প্রয়োগবিদ্যার যুগান্তরী পরিবর্তন ঘটল। চরকার ব্যবহারে কাপড়ের উৎপাদন ছয় গুণ বেড়ে যায়। তুলা আলাদা করার জন্য লাঠি পেটার বদলে ধনুকের ব্যবহার শুরু হল। সে যুগে তাঁতের ব্যবহার শুরু হয়নি বলে ইরফান হাবিব মন্তব্য করেছেন। তবে আদি মধ্যযুগে পাট কাপড় (মোটা কাপড়), মাহিন (অপেক্ষাকৃত সূক্ষ্ম), এবং মসলিন এই তিন প্রকার কাপড় তৈরি হতো। দেবগিরির মসলিন ছিল সবচেয়ে উৎকৃষ্ট তারপর বাংলার। গুজরাটে তাঁত এ রেশম মিশ্রিত। দিল্লিকে রেশম বস্ত্র পুজ আর মিশ্র বস্ত্র মাশরু নামে পরিচিত হতো। সোনা, রুপার জরির কাজের জন্য গুজরাট বিখ্যাত ছিল। প্রাক সুলতানি যুগ থেকে কাশ্মীরে শাল শিল্প প্রসিদ্ধ লাভ করে। সুলতানি যুগে সুলতান তার পরিবার এবং ক্রমবর্ধন অভিজাতদের চাহিদা এই শিল্পকে উন্নত করতে সাহায্য করেছিল।
বিশাল কাপড়ের শিল্পে বহু ধরনের শ্রমিক কাজ করত। মেয়েরা সাধারণত সুতা কাটতো। চরকার কাজ প্রধানত ছেলেরা করতো। ক্রমবর্ধন চাহিদার ফলে মেয়েরাও কাজ করতেন। তাতীরা নিজ বাড়িতেই কাপড় বুনতেন। এবং হাটে বা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করতেন
সুলতানি যুগে শহরে বহু মানুষ নির্মাণ কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এ যুগে যে প্রচুর স্থাপত্য কীর্তি নির্মিত হয়েছিল। যেখানে প্রয়োজনীয় ইট তৈরি, পাথরকাটা, রাজমিস্ত্রি এসব কাজে প্রচুর লোক লাগতো। সুলতানি যুগে ধাতুশিল্প যথেষ্ট উন্নত হয়েছিল। ভারতের ইস্পাতে তৈরি তরবারি সে যুগে পৃথিবীর অন্যতম সেরা ছিল। দক্ষিণ ভারতে ব্রোঞ্জ ও পিতল শিল্প ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। এখানকার পণ্য বিদেশী রপ্তানি হতো। মুদ্রায় ধাতু বিদ্যার উন্নত প্রয়োগের নিদর্শন পাওয়া যায়।
ত্রোয় শতকের পর চতুর্দশ শতক থেকে ভারতে কাগজের প্রচলন চালু হয়। কাগজের প্রচলন বেড়ে যাওয়ায় বই এর প্রচলন বাড়ে। বই নকল হতে থাকে। জানা যায় যে মিষ্টান্ন বিক্রেতা কাগজের ঠোঙার ব্যবহার করছেন। আমির খসরু দামি দুই ধরনের কাগজের কথা বলেছেন সাধারণ ও রেশমি ।
সুলতানি যুগে আখের রস থেকে গুড়, চিনি তৈরি হতো। চিনি নানা রকমের ছিল নরম চিনি, পরিশোধিত সাদা চিনি ইত্যাদি। উৎপাদিত চিনি বিদেশে রপ্তানির জন্য উদ্বৃত্ত হত। বাংলায় চিনির উৎপাদন ছিল সবচেয়ে বেশি।
সুলতানি যুগের চর্ম শিল্প একটি অপপ্রধান শিল্প। ঘোড়ার জিন, তরবারির খাপ, জুতো, চিনির পাত্র, নকশা খচিত মাদুর প্রভৃতি চর্মজাত দ্রব্য তৈরি হতো।
সুলতানি যুগে উৎপাদন জন সাধারণের দিকে নজর রেখে হত না। সুলতান ও অভিজাতদের চাহিদার দিকে তাকিয়ে উৎপাদন হতো। সুলতান ও অভিজাতরা নিজ প্রয়োজন মেটাতে রাজধানী এলাকায় কারখানা তৈরি করত। তারা কারিগরদের স্বার্থের দিকে খুব একটা তাকাতেন না। কারিগররা সংঘ গড়ে তুলেছে তার নজিরও রয়েছে। মোঃ হাবিব অবশ্য শহরতলীতে জাতপাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে শ্রমিকদের কাজ করার কথা উল্লেখ করেছেন। মোটের উপর উৎপাদন ছিল কম এবং প্রযুক্তি খুব উন্নতমানের ছিল না
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন