সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব

 

price revolution



16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত।


মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--  

 (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি।

(২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব।

(৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল।

(৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া।

(৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব।


ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভাবে অনুভূত হয়। 15 শতক এর তুলনায় ইংল্যান্ডে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ছিল ৫ গুণ, ফ্রান্সে ৭ গুণ, দক্ষিণের স্পেনে ৭এর ও বেশী। একটি তথ্য থেকে জানা যায় একজন ফরাসি রাজমিস্ত্রি ১৪৮০ সালে তার দৈনিক রোজগারের থেকে 30 পাউন্ড রুটি কিনতে পারতো, কিন্তু 1550 সালে 10 পাউন্ডের বেশি কেনা সম্ভব হচ্ছিল না।

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রথমদিকে ধর্মীয় নেতা ও প্রচারকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানুষ মজুতদার ও সুদের কারবারিদের এই দুর্বিপাকের জন্য দায়ী করেছিল। অনেক এলাকায় যে রুটির জন্য দাঙ্গা হয়েছিল সেখানে এই মজুতদার ও মহাজনরা আক্রান্ত হয়েছিল। জমিদারেরা খাজনা বাড়ানোর ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যয় সাপেক্ষ হয়ে যাওয়ায় খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটে  থাকতে পারে। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে ফরাসি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জ্যা বোদাঁ সর্বপ্রথম স্পষ্ট করেছেন যে, পণ্য এবং অর্থের প্রাচুর্য এবং  তাদের পরস্পরিক সম্পর্কই মূল্যের ওঠানামা নির্ধারণ করে দেয়। ষোড়শ শতকে বেশিরভাগ সরকারের চালু মুদ্রার পরিমাণ  এবং মূল্যের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্কে  বিষয়ে কোনো ধারণা ছিল না। বোঁদার মতে অর্থের এই  প্রাচুর্যের পিছনে কারণ ছিল স্পেনীয় শাসনাধীন দক্ষিণ আমেরিকা থেকে বিপুল পরিমাণে সোনা ও রুপা ইউরোপে পৌঁছানোর ঘটনা। এই প্রক্রিয়া স্পেনকে  ইউরোপের সমৃদ্ধিতম দেশে  পরিণত করে এবং বিভিন্ন সূত্র ধরে এই মূল্যবান ধাতু মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ার প্রতিক্রিয়ায় মুদ্রাস্ফীতি অনিবার্য হয়ে ওঠে।

অর্থনীতিবীদ কার্লো চিপোলা মূল্য বিপ্লবের তত্ত্বকে অতিরঞ্জিত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন মূল্যবৃদ্ধি বছরে ১.৪ শতাংশ এর বেশি হয়নি। পিয়ের, হুগুয়েট প্রমূখ গবেষক দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে স্বীকার করলেও একথা জানিয়েছেন যে, আমেরিকায় সোনা-রুপার আগমন দ্রব্যমূল্যে  বৃদ্ধির কারণ ছিল না। তাদের মতে সোনা-রুপার অত্যাধিক আমদানি ঘটেছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরে; আগে নয়। তাছাড়া আমেরিকা থেকে স্পেনের সেভিলে যে রুপা পৌছাতো তা আমদানিকৃত পণ্যের দাম মেটানো ছাড়াও বিদেশে স্পেনীয় সেনাদের ব্যয় মেটানো এবং জার্মানী ও জেনোয়ার ব্যাংকারদের ঋণ  শোধ করতেই খরচা হয়ে যেত। সুতরাং, স্পেন সোনা-রুপার  উদ্বৃত্ত নয়, বরং ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছিল। মূল্যবৃদ্ধি মহাদেশের ঘটেনি। দাম বেড়েছিল খাদ্যশস্য এবং শিল্পজাত পণ্যের। মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিকও ছিল না, সুতরাং মূল্যবৃদ্ধির কারণ অন্যত্র খুঁজতে হবে।

বোঁদার বিকল্প তত্ত্ব হিসেবে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী করা হয়েছে, যদিও এই সময়ে জনস্ফীতির সঠিক পরিমাণ করা যায় না। তবুও বিভিন্ন তথ্য দেখে অনুমান করা হয় লোকসংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পশ্চিম ও দক্ষিণ ইউরোপের খেত খামারের উপর চাপ স্বাভাবিকভাবেই বাড়ছিল। ভূমিহীন কৃষকদের সংখ্যা বাড়ছিল। বিরল বসতি অঞ্চলে এবং উপনিবেশগুলিতে অনাবশ্যক মানুষ পাঠিয়েও সমস্যার সমাধান করা যায়নি। তাই উৎপাদন ও চাহিদার ক্ষেত্রে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, এবং খাদ্য দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়। উপরন্ত খাজনা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন, খরচ বৃদ্ধি পায় এবং মূল্য বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে।

উপযুক্ত তথ্যের অভাবে পশ্চিম ইউরোপের গ্রামীণ অর্থনীতিতে মূল্য বিপ্লবের কি প্রভাব পড়েছিল, তা নিয়ে সর্বজন গ্রাহ্য সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হয়নি। খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভূস্বামীরা নিজেরাই চাষাবাদে অংশ নিতে থাকি। এবং স্বল্প মেয়াদী শর্তে জমি ইজারা দিতে শুরু করে, ফলে ইংল্যান্ডের কপি-হোল্ডাররা জমি হারায়।

মূল্য বিপ্লবের ফলাফল

মুদ্রাস্ফীতি, খাজনা বৃদ্ধি ও মজুরি হ্রাসের ফলে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষ বেশী অসুবিধায় পড়েছিল। কৃষকদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যারা উদ্বৃত্ত উৎপাদন করতে পেরেছিল তাদের কিছুটা সুবিধা হয়েছিল। কিন্তু প্রান্তিক চাষী, যারা পণ্য বাজারজাত করবে পারত না তারা সমস্যার মধ্যে পড়েছিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধি সেভাবে  না হওয়ায় প্রকৃত মজুরি কার্যত হ্রাস পেয়েছিল। একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যায় ১৬ শতকের শুরুর দিকে আউসবার্গের নির্মাণ কর্মী তার চার জনের পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে পারতো, কিন্তু ১৭ শতকে সুচনায়  তার পক্ষে পরিবার চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। এদিকে আবার খাদ্যদ্রব্য নয় এমন পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ার ফলে, শ্রমের যোগান থাকলেও কাজ পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।

 সামন্ত ব্যবস্থার উপরেও মূল্যবৃদ্ধি প্রভাব ফেলেছিল। পশ্চিম ইউরোপের সামন্তপ্রভুরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। অনেকেই বুর্জোয়াদের কাছে জমি বেচে দিয়েছিল। ইংল্যান্ডের জেন্ট্রি সম্প্রদায় এই পরিস্থিতির সুযোগে আয় বাড়াতে সক্ষম হয়েছিল। পূর্ব ইউরোপে অবশ্য বড় জমির মালিকরা লাভবান হয়েছিল। বুর্জোয়াদের  হাতে জমি চলে যাওয়ায় কৃষির বাণিজ্যিকরণ সম্ভব হয়েছিল।

 মূল্য বিপ্লব সমকালীন সামাজিক পরিস্থিতিকেও প্রভাবিত করেছিল। দরিদ্র ক্রমশ আরো দরিদ্র হয়েছিল। ফলে ভিক্ষুক, ভবঘুরে এবং অসামাজিক কাজকর্ম করার লোকজনের সংখ্যা বেড়েছিল এবং সমাজে আর্থিক বৈষম্য বেড়েছিল। সরকারকে এই নিয়ে উদ্বেগপূর্ণ হতে দেখা গেছে। বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। জার্মানির কৃষক বিদ্রোহ (১৫২৫)  এরকমই প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানসিকতার প্রমাণ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক