সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মধ্যযুগে ইউরোপে নগরের উত্থানের কারণ | Rise of Urban Centers in Medieval Europe

মধ্যযুগে ইউরোপে নগরের উত্থানের কারণ

পঞ্চম থেকে নবম শতক পর্যন্ত ইউরোপের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে যে নতুন গতিশীলতা এসেছিল তারই অন্যতম ফলশ্রুতি ছিল দ্বাদশ শতকীয় নগরায়ন। সামন্ততন্ত্রের যুগেই সামন্ততন্ত্রের বিপরীতমুখী প্রবৃত্তিগুলি আত্মপ্রকাশ করেছিল। এরমধ্যে প্রধানতম হল ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্ভব, বণিক শ্রেণীর আবির্ভাব এবং নগরায়ন। সমগ্র দ্বাদশ শতক জুড়ে নগরের সংখ্যা অভাবনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। অনেক পন্ডিত মনে করেন এই সময়ে কোন নতুন নগরের পত্তন হয়নি বরং রোম সাম্রাজ্যের নগরগুলি দশম শতক থেকে আবার পুন‌ঃর্জীবিত হয়ে উঠেছিল। লন্ডন এবং প্যারিসের কথা এই ধরনের নগরায়নের উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। কিন্তু এই চিত্র সার্বিক নয়। ইতালির বহু শহর এই সময় শিল্পায়ন ও বাণিজ্যের সুবাদে গড়ে উঠেছিল। 

মধ্যযুগের নগরগুলির উৎপত্তির প্রধান কারণ ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের অভাবনীয় অগ্রগতি। হেনরি পিরেন লিখেছেন মধ্যযুগে শহরের বিকাশ রোম সাম্রাজ্যের যুগ থেকে শুরু হয়েছিল। ক্যারোলিঞ্জীয় যুগে এই ধারা ব্যাহত হয়েছিল। বর্বর জার্মানরা রোম সাম্রাজ্যের পতন ঘটালেও তারা শহর ধ্বংসের খেলায় মেতে ওঠেনি। তাই পুরানো শহরগুলি তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। একাদশ শতকে বাণিজ্যিক তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শহর গড়ে ওঠার পথ প্রশস্ত হয়েছিল। সমুদ্রের উপকূলে বা নদীর তীরে বাণিজ্যকেন্দ্র গুলি গড়ে উঠত। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে এই ধরনের একাধিক বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। স্থানীয় শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমুদ্র তীরবর্তী এই বাণিজ্যসমৃদ্ধ জনপদগুলি ক্রমশ নগরে পরিণত হয়েছিল। 

নগরায়নের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অনুঘটক ছিল গিল্ড বা নিগম গুলি। এগুলি ছিল কারিগরি উৎপাদন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান। শুধু অর্থনীতিতে এদের প্রভাব ছিল না, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবেও গিল্ডগুলি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। গিল্ডের এই প্রভাব প্রতিপত্তির সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বাজার গড়ে তুলত। বাজার গুলিকে কেন্দ্র করে সেখানে জনসমাগম হত এবং এগুলি নতুন নতুন নগর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করত। ইতালির ভেনিস, জেনয়া এবং পিসা ছিল এই ধরনের নগর। 

নগরের উৎপত্তি ও বিকাশে ক্রুসেডের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ক্রুসেড ব্যবসা-বাণিজ্যকে ত্বরান্বিত করেছিল এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। ক্রুসেডের ফলে একইসাথে প্রাচ্য দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। ক্রুসেডের উদ্দেশ্যে বহু মানুষ প্রাচ্য দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগক্ষেত্র গুলিতে দোকানপাট, যাত্রী নিবাস ইত্যাদি গড়ে ওঠে এবং এগুলি ধীরে ধীরে শহরের রূপ ধারণ করে। বার্লিন, মিউনিখ, বুদাপেস্ট, জুরিখ প্রভৃতি শহর গুলি এভাবেই ইউরোপের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করেছিল। 

মধ্যযুগের ইউরোপে বহু খ্রিস্টান মঠের উপস্থিতি ছিল। বর্বর আক্রমণের ফলে চারিদিক যখন ধ্বংসলীলা নেমেছিল। তখন মানুষের কাছে সুনিশ্চিত আশ্রয়ের জায়গা ছিল মঠগুলি। অনেকেই সন্ন্যাস গ্রহণ করে মঠজীবনকে বেছে নেন। এভাবে মঠগুলির কলেবর বৃদ্ধি হয়। ক্রুসেড মঠগুলির সম্পত্তি বৃদ্ধি ঘটায়। মঠগুলি ধর্মচর্চার পাশাপাশি কৃষিকাজ, কারিগরি উৎপাদন প্রভৃতি অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ চালত। ফলে মঠগুলিকে কেন্দ্র করে ক্রমশ নগর গড়ে উঠতে থাকে। 

বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রগুলি শুধু নয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র গুলিও নগরায়নকে প্রভাবিত করে। মধ্যযুগের ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে ছাত্র, অধ্যাপক এবং গবেষকরা দেশ-বিদেশ থেকে হাজির হতেন। ফলে সেখানেও জনসমাগম হত। তার দরুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাণিজ্য গড়ে উঠত। এগুলি পরবর্তীকালে শহরে পরিণত হয়। এভাবেই অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিস্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে শহর গড়ে উঠেছিল। 

যেকোনো নগরায়নের পূর্ব শর্ত হল উদ্বৃত্ত উৎপাদন এবং যথার্থ শ্রমের যোগান। দ্বাদশ শতকে ইউরোপে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে ম্যানর গুলিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। আবার বর্ধিত জনসংখ্যার সংকট মোচনের জন্য ম্যানর গুলিতে কৃষির পাশাপাশি তাঁত বোনা, ছুতোর কাজ প্রভৃতি পেশার উদ্ভব ঘটেছিল। সামন্ত প্রভু এই সমস্ত পণ্য বাইরের বিক্রির অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছিল। এর সুযোগ নিয়ে অনেকেই মুক্ত হয়ে গেল। এই মুক্ত ভূমিদাসেরা বাজারের আশেপাশে তাদের কারিগরি বসতি গড়ে তুলত। ইতালির ফ্লোরেন্স এবং ফ্লান্ডার্স এই ধরনের শহর। যেখানে বর্ধিত ভূমিদাসদের জীবিকার ব্যবস্থা হয়নি সেই ম্যানরগুলি থেকে ভূমিদাসদের পালিয়ে যাওয়া এবং শহরে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকে। এর ফলে শহরের শিল্পায়ন সস্তা শ্রমের যোগান পায় এবং তা আরো বেশি উন্নত হয়, যা নগরের বিকাশকে প্রভাবিত করে।

Rise of Urban Centers in Medieval Europe

From the fifth to the ninth century, a new dynamism emerged in the economic and social life of Europe, one of the outcomes of which was the urbanization of the twelfth century. Even during the era of feudalism, tendencies contrary to feudalism began to manifest. Among these, the most significant were the rise of trade and commerce, the emergence of the merchant class, and urbanization. Throughout the twelfth century, the number of cities increased remarkably. Many scholars believe that no new cities were founded during this period; rather, the cities of the Roman Empire were revived from the tenth century onwards. London and Paris can be cited as examples of such urbanization. However, this was not the case everywhere. Many cities in Italy flourished during this time due to industrialization and trade.

The primary reason for the rise of medieval cities was the unprecedented progress in trade and commerce. Henri Pirenne wrote that the development of cities in the Middle Ages began in the era of the Roman Empire. This trend was disrupted during the Carolingian period. Although the barbarian Germans caused the fall of the Roman Empire, they did not engage in the destruction of cities. Thus, the old cities were able to maintain their existence. In the eleventh century, the increase in commercial activities and population growth paved the way for the formation of cities. Trade centers emerged along the coasts or riverbanks. Several such trade centers developed in the Mediterranean region. With the patronage of local rulers, these prosperous trade settlements gradually transformed into cities.

Another significant economic catalyst for urbanization was the guilds or trade associations. These were regulatory bodies for artisanal production and commerce. Their influence was not limited to the economy; guilds also became politically and socially important. Taking advantage of the guilds' influence, merchants established markets. These markets attracted people, and over time, they developed into new cities. Cities like Venice, Genoa, and Pisa in Italy were examples of this phenomenon.

The Crusades played a crucial role in the origin and development of cities. There is no doubt that the Crusades accelerated trade and commerce. The Crusades also established close connections with Eastern countries. Many people set out for the East during the Crusades, leading to the establishment of shops, inns, and other facilities at key transit points, which gradually grew into cities. Cities like Berlin, Munich, Budapest, and Zurich emerged on the map of Europe in this manner.

Medieval Europe was home to many Christian monasteries. During the barbarian invasions, when destruction was rampant, monasteries provided a safe haven for people. Many chose monastic life, leading to the expansion of monasteries. The Crusades increased the wealth of these monasteries. Besides religious activities, monasteries engaged in agriculture, artisanal production, and other economic activities. As a result, cities began to develop around these monasteries.

Not only commercial and religious institutions but also educational centers influenced urbanization. Students, professors, and researchers from various countries gathered at medieval European universities. This led to the congregation of people, and trade developed around these universities. Over time, these areas turned into cities. Oxford and Cambridge are examples of cities that grew around universities.

A prerequisite for any urbanization is surplus production and an adequate supply of labor. In the twelfth century, Europe experienced rapid population growth, leading to increased production in manors. To address the challenges of the growing population, professions like weaving and carpentry emerged alongside agriculture in manors. Feudal lords were compelled to allow the sale of these products outside the manor. Many took advantage of this opportunity to gain freedom. These freed serfs established artisanal settlements around markets. Cities like Florence in Italy and Flanders are examples of this. Where the increased serfs could not find livelihoods in the manors, they fled and sought refuge in cities. This provided cities with cheap labor, furthering industrialization and influencing urban development.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...