সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভিয়েনা চুক্তি | The Treaty of Vienna

ভিয়েনা চুক্তি

নেপোলিয়ন পরবর্তী বিশ্বেব্যবস্থা কি হবে তা নির্ধারিত হয়েছিল ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা সম্মেলনে। নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার আগেই নেপোলিয়নের বিরোধী চারটি বৃহৎ ইউরোপীয় শক্তি ব্রিটেন, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া নিজেদের মধ্যে একটি চতুঃশক্তি মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল, যার মূল বক্তব্য ছিল, আগামী দিনে ফ্রান্স যাতে শান্তি প্রক্রিয়ার যাবতীয় শর্ত মেনে চলে তার জন্য পরবর্তী ২০ বছর নিজেদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা হবে। যুদ্ধ সমাপ্ত হবার পর উপরোক্ত চারটি শক্তি এবং পরাজিত ফ্রান্সের কূটনীতিবিদরা অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে মিলিত হলেন। ভিয়েনা সম্মেলনে মূলত তিনটি নীতি নির্ধারিত হয়েছিল-- ১. আঞ্চলিক পুনর্বন্টন ও ক্ষতিপূরণ নীতি, ২. ন্যায্য অধিকার নীতি এবং ৩. শক্তিসাম্য নীতি।

আঞ্চলিক পুনর্বন্টন ও ক্ষতিপূরণ বলতে বোঝানো হয়েছিল যে সমস্ত শক্তি নেপোলিয়নকে পরাজিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে এবং যারা নেপোলিয়নকে সহযোগিতা করেছিল তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই নীতি অনুসারে ব্রিটেন দুটি ফরাসি অধিকৃত দ্বীপ সেন্ট লুসিয়া ও টোবাগো লাভ করেছিল। এছাড়া ওলন্দাজ উপনিবেশ সিংহল দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তামাশা অন্তরীপ এবং ওলন্দাজ গিয়ানা লাভ করেছিল। এর ফলে হল্যান্ডের যে ক্ষতি হলো তা পূরণ করার জন্য অস্ট্রিও নেদারল্যান্ডস হল্যান্ডকে অর্পণ করা হল। ভেনিস ও মিলান অস্ট্রিয়াকে দিয়ে অস্ট্রিয়ার ক্ষতিপূরণ করা হল। অস্ট্রিয়ার হ্যাপসবর্গ রাজবংশজাত ব্যক্তিদের হাতে টাস্কেনি, পার্মা ও মডেনার শাসন দেয়া হল। পোল্যান্ডের একটা বড় অংশ লাভ করেছিল রাশিয়া, সুইডেনের ফিনল্যান্ড ও তুরস্কের বেসারাবিয়ার উপরে রাশিয়ার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ডেনমার্ক যেহেতু নেপোলিয়নকে সমর্থন করেছিল তাই তার কাছ থেকে নরওয়েকে কেড়ে নিয়ে সুইডেনের হাতে দেওয়া হল। ইতালিকে পুনরায় বিভক্ত করা হল। ইটালিয় রাজ্য স্যভয়, পিটমন্ট ও জেনোয়ার শাসন পেলেন ভিক্টর প্রথম ইমানুয়েল। বুরবোঁ রাজা ফারদিনান্দকে সিসিলি ও নেপলস দেওয়া হল। জার্মানিকে আগের মত ভেঙে ৩৯টি রাজ্য গড়ে তোলা হল এবং এগুলি নিয়ে কনফেডারেশন অফ দা রাইন গঠন করে তার দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হল অস্ট্রিয়ার উপর। ফ্রান্স আলসাস ও লরেন লাভ করেছিল।

বৈধ অধিকার নীতির অর্থ ছিল প্রাক বিপ্লব ইউরোপীয় সীমান্তগুলিকে ফিরিয়ে আনা এবং ইউরোপের যে সমস্ত রাজবংশ বিভিন্ন দেশের রাজত্ব করত তাদের বংশধরদের সেই সমস্ত দেশের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করা। এই নীতি অনুসারে স্পেন, ফ্রান্স ও ইটালিতে পূর্ববর্তী তথা বৈধ শাসকদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হল। স্যাভয় রাজবংশের সদস্য পিডমন্ট সারডিনিয়ায়, অরেঞ্জ বংশের সদস্য হল্যান্ডে, ষোড়শ লুইয়ের ভ্রাতা অষ্টাদশ লুই ফ্রান্সের শাসক হলেন। পোপের এলাকায় পোপের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। শান্তির স্থপতিরা বৃহৎ রাজ্যের ক্ষেত্রে 'বৈধ'দের অধিকার ফিরিয়ে দিলেও ক্ষুদ্র রাজ্যগুলির ক্ষত্রে সেই অধিকার রক্ষিত হয় নি। 

আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষার জন্য ভিয়েনা সম্মেলনে শক্তিসাম্য নীতি গৃহীত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ফ্রান্স যাতে পুনরায় শক্তিশালী হয়ে আগ্রাসনের পথ না ধরে সেজন্য ফ্রান্সের চারিদিকে একটা নিরাপত্তা প্রাচীর গড়ে তোলা হয়েছিল। ফ্রান্সের সীমানাকে বিপ্লব- পূর্ব সীমানায় ঠেলে দেওয়া হল। ফ্রান্সের আশেপাশের ছোটো রাজ্যগুলিকে বৃহৎ শক্তির সাথে জুড়ে দিয়ে একটা বলয় তৈরী করা হল।

১৬৪৮ এর পর ইউরোপের সবথেকে বড় শান্তি চুক্তি ছিল ভিয়েনা চুক্তি। ডেভিড টমসন ভিয়েনা চুক্তিকে একটি যুক্তিগ্রাহ্য ও কূটনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন বন্দোবস্ত বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু এই বন্দোবস্তের অনেক ত্রুটি ছিল। মুখে ন্যায্য অধিকারের কথা বলা হলেও শুধু বৃহৎ শক্তিগুলি নিজেদের স্বার্থে এই নীতির প্রয়োগ ঘটিয়েছিল। ইউরোপের মানচিত্র থেকে জেনোয়া ও ভেনিস অবলুপ্ত হয়েছিল। শক্তি সাম্যের নামে কেবল ফ্রান্সকে দুর্বল করে রাখার প্রয়াস চলেছিল। তাছাড়া সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি কার্যকর করার জন্য কোনো প্রচেষ্টা ছিল না। উদাহরণস্বরূপ স্পেন পর্তুগালকে অলিভেরগা দিতে অসম্মত হলে কেউ স্পেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় নি। তবে যাই হোক ভিয়েনা বন্দোবস্ত দীর্ঘ সময় ইউরোপে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে পেরেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 

The Treaty of Vienna

The post-Napoleonic world order was determined at the Congress of Vienna in 1815. Even before the wars against Napoleon had ended, four major European powers opposed to him—Britain, Russia, Austria, and Prussia—had entered into a Quadruple Alliance. The main objective of this alliance was to maintain unity among themselves for the next twenty years to ensure that France would comply with all the conditions of the peace settlement. After the end of the war, diplomats from these four powers, along with those from defeated France, met in Vienna, the capital of Austria. At the Congress of Vienna, three main principles were formulated:

  1. The principle of territorial redistribution and compensation,

  2. The principle of legitimacy, and

  3. The principle of balance of power.

The principle of territorial redistribution and compensation meant that the powers which had played a significant role in defeating Napoleon would be rewarded, while those that had supported Napoleon would be punished. Under this principle, Britain gained the French-occupied islands of St. Lucia and Tobago. In addition, Britain acquired the Dutch colony of Ceylon, the Cape of Good Hope in South Africa, and Dutch Guiana. To compensate for the losses suffered by Holland, the Austrian Netherlands were transferred to it. Austria was compensated with Venice and Milan. Members of the Austrian Habsburg dynasty were given control over Tuscany, Parma, and Modena. Russia acquired a large part of Poland and established control over Finland (from Sweden) and Bessarabia (from Turkey). Since Denmark had supported Napoleon, Norway was taken away from Denmark and given to Sweden. Italy was once again divided. Victor Emmanuel I was given control over Savoy, Piedmont, and Genoa. The Bourbon king Ferdinand was given Sicily and Naples. Germany was again fragmented into 39 states, which were organized into the German Confederation under Austrian supervision. France retained Alsace and Lorraine.

The principle of legitimacy meant restoring the pre-revolutionary boundaries of Europe and reinstating the descendants of the dynasties that had ruled various countries on their respective thrones. According to this principle, the former legitimate rulers were restored in Spain, France, and Italy. A member of the House of Savoy was restored to Piedmont-Sardinia, a member of the House of Orange to Holland, and Louis XVIII, the brother of Louis XVI, became the ruler of France. Papal authority was restored in the Papal States. While the architects of peace restored the rights of legitimate rulers in major states, this principle was not applied to smaller states.

To maintain international peace, the Congress of Vienna adopted the principle of balance of power. In reality, this was intended to prevent France from regaining strength and pursuing aggression. A security belt was created around France. Its borders were pushed back to the pre-revolutionary boundaries, and neighboring small states were attached to larger powers to form a protective ring around it.

After 1648, the Treaty of Vienna was the most significant peace settlement in Europe. David Thomson described the Vienna settlement as a rational and diplomatically informed arrangement. However, it had many shortcomings. Although the principle of legitimacy was proclaimed, it was applied only by the great powers in pursuit of their own interests. Genoa and Venice disappeared from the map of Europe. In the name of maintaining the balance of power, efforts were made solely to weaken France. Moreover, there was no effective mechanism to enforce the decisions taken at the Congress. For example, when Spain refused to hand over Olivenza to Portugal, no action was taken against Spain. Nevertheless, there is no doubt that the Vienna settlement succeeded in maintaining stability in Europe for a long period.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...