সন্ত্রাসের রাজত্ব
ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্ব (১৭৯৩–১৭৯৪) এক ভয়াবহ ও বিতর্কিত অধ্যায়। এই পর্যায়ে বিপ্লবের ঘোষিত আদর্শ—স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব—বাস্তবে ভয়, সন্দেহ ও সহিংসতার মাধ্যমে কার্যকর করা হয়। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, বৈদেশিক আক্রমণের আশঙ্কা এবং বিপ্লব-বিরোধী শক্তির উত্থানের প্রেক্ষাপটে বিপ্লবী সরকার কঠোর দমননীতির আশ্রয় নেয়। এই সময়েই বিপ্লব তার সবচেয়ে চরম ও রক্তক্ষয়ী রূপ ধারণ করে।
১৭৯২ সালে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের পতন ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর দেশটি গভীর সংকটে পড়ে। একদিকে অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপীয় শক্তিগুলি বিপ্লব দমন করার জন্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে; অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে রাজতন্ত্রপন্থী, গির্জা সমর্থক এবং প্রাদেশিক বিদ্রোহ (বিশেষত ভঁদে অঞ্চলে) বিপ্লবী সরকারের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। এই দ্বিমুখী সংকট মোকাবিলার জন্য বিপ্লবীরা মনে করেন যে কঠোর ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া বিপ্লব রক্ষা করা সম্ভব নয়।
এই সময়ে জ্যাকোবিন দল বিপ্লবী রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে। ১৭৯৩ সালে জনকল্যাণ কমিটি (Committee of Public Safety) গঠিত হয়, যা কার্যত ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। ম্যাক্সিমিলিয়ান রবেস্পিয়ার, জর্জ কুথোঁ ও সাঁ-জ্যুস্ত প্রমুখ নেতারা এই কমিটির নেতৃত্ব দেন। তাঁদের মতে, বিপ্লব রক্ষার জন্য ‘গুণের সঙ্গে সন্ত্রাস’ অপরিহার্য—অর্থাৎ নৈতিক বিপ্লবী আদর্শ বজায় রাখতে হলে বিপ্লবের শত্রুদের নির্মূল করতেই হবে।
সন্ত্রাসের রাজত্ব কার্যকর করার জন্য একাধিক কঠোর আইন প্রণয়ন করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৭৯৩ সালের ‘সন্দেহভাজন আইন’ (Law of Suspects)। এই আইনের মাধ্যমে যে কাউকে—অভিজাত, যাজক, মধ্যবিত্ত এমনকি সাধারণ নাগরিককেও—বিপ্লবের শত্রু সন্দেহে গ্রেপ্তার করা যেত। বিপ্লবী ট্রাইব্যুনাল দ্রুত বিচার পরিচালনা করত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।
এই সময়ের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রতীক ছিল গিলোটিন। বিপ্লবের শত্রুদের ‘ন্যায়সঙ্গত’ ও ‘সমান’ শাস্তির প্রতীক হিসেবে গিলোটিন ব্যবহার করা হলেও বাস্তবে এটি গণহত্যার যন্ত্রে পরিণত হয়। হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১৭,০০০ মানুষকে আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং আরও বহু মানুষ বিনা বিচারে বা কারাগারে প্রাণ হারায়। এই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন রাজা ষোড়শ লুই, রানি মারি আঁতোয়ানেত, জিরন্দিন নেতা, বহু যাজক, অভিজাত এবং এমনকি বিপ্লবের সমর্থক সাধারণ মানুষও।
সন্ত্রাসের রাজত্ব কেবল রাজনৈতিক দমননীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি সমাজ ও অর্থনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলে। খাদ্যসংকট মোকাবিলার জন্য সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণ আইন (Law of Maximum) প্রণয়ন করে। ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। একদিকে এর ফলে দরিদ্র জনগণের মধ্যে বিপ্লবী সরকারের জনপ্রিয়তা কিছুটা বাড়ে, অন্যদিকে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যাহত করে।
এই সময়ে খ্রিস্টধর্মবিরোধী আন্দোলন (De-Christianization) জোরদার হয়। গির্জা বন্ধ করা হয়, ধর্মীয় আচার নিষিদ্ধ করা হয় এবং নতুন বিপ্লবী ক্যালেন্ডার চালু করা হয়। রবেস্পিয়ার যদিও সম্পূর্ণ নাস্তিকতাকে সমর্থন করেননি, তবু তিনি ‘Supreme Being’-এর পূজার মাধ্যমে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। এর ফলে ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বিপ্লবী সরকারের দূরত্ব আরও বেড়ে যায়।
১৭৯৪ সালের মধ্যভাগে সন্ত্রাসের রাজত্ব নিজের সীমা ছাড়িয়ে যায়। বিপ্লবী নেতারাই পরস্পরের বিরুদ্ধে সন্দেহ করতে শুরু করেন। রবেস্পিয়ারের ক্ষমতা ও নৈতিক কর্তৃত্ব ক্রমে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে ২৭ জুলাই ১৭৯৪ (৯ থার্মিডর) রবেস্পিয়ার ও তাঁর অনুগতদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরদিন গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। এর মধ্য দিয়েই সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটে।
সন্ত্রাসের রাজত্ব ফরাসি বিপ্লবের সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায়। একদিকে এটি বিপ্লবকে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করেছিল এবং প্রজাতন্ত্রকে সাময়িক স্থিতিশীলতা দিয়েছিল। অন্যদিকে অতিরিক্ত সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্বিচার হত্যাকাণ্ড বিপ্লবের নৈতিক ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন, সন্ত্রাস ছিল পরিস্থিতির চাপে গৃহীত এক অনিবার্য ব্যবস্থা; অন্যরা একে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিপ্লবী আদর্শের বিকৃতি হিসেবে দেখেন।
সন্ত্রাসের রাজত্ব প্রমাণ করে যে বিপ্লব কেবল আদর্শের দ্বারা পরিচালিত হয় না, বরং ভয়, ক্ষমতা ও পরিস্থিতির চাপও তার গতিপথ নির্ধারণ করে। এই অধ্যায় মানব ইতিহাসকে সতর্ক করে দেয় যে ন্যায় ও নিরাপত্তার নামে সীমাহীন দমননীতি শেষ পর্যন্ত বিপ্লবকেই গ্রাস করতে পারে। তবু সন্ত্রাসের রাজত্ব ফরাসি বিপ্লবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা বিপ্লবের সাফল্য ও ব্যর্থতা—উভয়কেই স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন