মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা ও নেপলিয়নের পতন
নেপোলিয়নের প্রধান শত্রু ছিল ইংল্যান্ড। ১৮০৫ থেকে ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নেপোলিয়ন প্রায় সমস্ত ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বীকে পদানত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ইংল্যান্ড ছিল অপরাজেয়। প্রথম দিকে নেপোলিয়ন সরাসরি ইংল্যান্ড আক্রমণ করে জয়লাভের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ১৮০৫ সালের ট্রাফালগারের যুদ্ধে ফ্রান্স ও স্পেনের যৌথ বাহিনী ইংল্যান্ডের হাতে শুধু পরাজিতই নয়, বিধ্বস্ত হয়েছিল। এরপর থেকে নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডকে সরাসরি আক্রমণ করার পরিকল্পনা ত্যাগ করেন এবং ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ ঘোষনা করেন যা মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা নামে পরিচিত।
ইংল্যন্ডের অর্থনৈতিক ধ্বংসসাধন এবং ফরাসি অর্থনীতির বিকাশসাধন– এই দ্বিমুখী উদ্দেশ্য নিয়ে নেপোলিয়ন মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা চালু করেন। ইংল্যান্ডের শক্তির প্রধান উৎস ছিল তার ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য ও বাণিজ্য সম্পদ। ইউরোপের দেশগুলি ছিল ইংল্যান্ডের শিল্পজাত দ্রব্যের প্রধান ক্রেতা। তাই ইউরোপের বন্দর সমূহে ইংল্যান্ডের পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিলে ইংল্যান্ডের বাণিজ্য নষ্ট হবে এবং ওর অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। অন্যদিকে ওইসব আমদানিকারক দেশগুলি তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য ফ্রান্সের কাছ থেকে যদি ক্রয় করে তাহলে ফ্রান্সের অর্থনীতিতে জোয়ার আসবে। ফ্রান্সে বুর্জোয়া শ্রেনী নেপোলিয়নের স্বৈরতন্ত্রের প্রধান সমর্থক হয়ে উঠবে।
মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থার প্রথম পদক্ষেপ ছিল ১৮০৬ সালের বার্লিন ডিক্রি। এই ডিক্রি জারি করে বলা হয়েছিল যে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ অবরুদ্ধ থাকবে, ফ্রান্স ও তার মিত্র দেশ বা কোন নিরপেক্ষ দেশ ইংল্যান্ডের সাথে বাণিজ্য করতে পারবেনা। ইংল্যান্ড থেকে ইউরোপে এবং ইউরোপ থেকে ইংল্যান্ডে যেসব পণ্য পাঠানো হবে ফ্রান্স সেগুলি বাজেয়াপ্ত করবে। অস্ট্রিয়া ও রাশিয়া টিলজিটের সন্ধির মাধ্যমে এই নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়েছিল। এর প্রত্যুত্তরে ইংল্যান্ড ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে Orders in Council জারি করে বলেছিল যে, নিরপেক্ষ দেশগুলি ইউরোপীয় ভূখণ্ডে বাণিজ্য করতে চাইলে ইংল্যান্ড কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত শুল্ক দিয়ে লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ব্রিটিশ নৌবহর তাদের পণ্যবাহী জাহাজগুলি বাজেয়াপ্ত করবে। Orders in Council এর প্রতিবাদে ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে মিলান ডিক্রি জারি করে নেপোলিয়ন ঘোষনা করেন, যে সমস্ত জাহাজ ব্রিটেন থেকে লাইসেন্স নেবে সেগুলো ব্রিটিশ সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হবে এবং সেগুলিও বাজেয়াপ্ত করা হবে। ফন্টেন ব্লোঁ ডিক্রি জারি করে আরও বলা হয় যে এই সমস্ত বাজেয়াপ্ত করা জাহাজ প্রকাশ্যে অগ্নিদগ্ধ করা হবে।
নেপোলিয়ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক চালু করেছিলেন কিন্তু ইউরোপের বিশাল উপকূল ভাগ পাহারা দেওয়ার মত নৌবহর তাঁর ছিল না। তাছাড়া অবাধ্য দেশগুলিকে মহাদেশীয় প্রথা মানতে বাধ্য করার জন্য তাকে যুদ্ধের ঝুকিয়ে নিতে হয়েছিল। কিন্তু ইংল্যান্ড এই পরিস্তিতিতে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। ইংল্যান্ড উত্তর ইউরোপের বাজার উন্মুক্ত রাখার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কোপেহেগেনের উপর অনবরত অভিযান চালিয়ে ইংল্যান্ড বাল্টিক সাগর অঞ্চলে তার বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছিল। কিন্তু নিরপেক্ষ দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য করা বন্ধের চেষ্টা নেপোলিয়ন চালালেও চোরাপথে ইংল্যান্ডের পণ্য ইউরোপে পৌঁছে যেত, কারণ ইউরোপের বাজারে এই সমস্ত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ছিল। তবে Orders in Council সাময়িক ভাবে নিরপেক্ষ দেশগুলিকে, বিশেষ করে আমেরিকাকে বিরক্ত করেছিল। এর ফলে ইংল্যান্ডের ইউরোপীয় বাণিজ্য অবনতি দেখা দিলে বাধ্য হয়ে ইংল্যান্ড লাইসেন্স ব্যপারে উদারতা প্রদর্শন করতে থাকে। ১৮১০-১২ খ্রিস্টাব্দে নাগাদ ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক জীবনে মহাদেশীয় প্রথার কিছুটা প্রভাব পড়ে। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে উৎপাদন হ্রাস, খাদ্য সমস্যা, বেকারত্ব, মজুরির হ্রাস ও শ্রমিক আন্দোলন ইংল্যান্ডের জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। কিন্তু নেপোলিয়ন এই অবস্থার সুযোগ না নিয়ে হল্যান্ড ও ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডে গম রপ্তানি করে। রাশিয়া মহাদেশী ব্যবস্থা অস্বীকার করে ইংল্যান্ডের সাথে বাণিজ্য শুরু করলে ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক সংকট দূর হয়। ১৮১১ ছাড়া ইংল্যান্ডকে আর কোনো বড় বিপাকে পড়তে হয়নি। তাছাড়া পুরানো ইউরোপীয় বাজারের পরিবর্তে ইংল্যান্ড দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, দূরপ্রাচ্যের তুরস্ক ও বাল্টিক সাগর তীরবর্তী দেশগুলির সঙ্গে নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।
মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা নেপোলিয়নের জনপ্রিয়তা হ্রাসের একটি অন্যতম কারণ। ইউরোপের বাজারে ব্রিটিশ শিল্পজাত পণ্যের যা চাহিদা ছিল তা পূরণ করার জন্য যে হারে ফ্রান্সে দ্রুত শিল্পায়নের প্রয়োজন ছিল তা ফ্রান্সের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ ইংল্যান্ডের অর্ডারস ইন কাউন্সিলের কারণে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলি থেকে ফ্রান্সে কাঁচামাল আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ফলে শিল্পজাত দ্রব্য সামগ্রীর অভাবে ইউরোপের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। ১৮১০ থেকে ১৮১২ এর অর্থনৈতিক মন্দার ফলে ফ্রান্সের বুর্জোয়া শ্রেণীও নেপোলিয়ন বিরোধী হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি ও জনমতের চাপে নেপোলিয়ান তার শত্রু দেশ ইংল্যান্ডে পণ্য রপ্তানির জন্য ফরাসি বণিকদের লাইসেন্স প্রদান করেন। তবে এক্ষেত্রে কেবল ফরাসী বণিকরা সুবিধা পাওয়ায় মিত্র দেশগুলি, বিশেষত রাশিয়া ক্ষুব্ধ হয়। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া মহাদেশীয় ব্যবস্থা অমান্য করে। এদিকে ইউরোপের অপরাপর দেশ, যেমন– হল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড এবং বাল্টিক সাগর তীরবর্তী দেশগুলি এই ব্যবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পর্তুগালতো এই ব্যবস্থা স্বীকারই করেনি। ফলে সমগ্র ইউরোপে এমন কি স্বদেশেও নেপোলিয়ান বিরোধী ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
ঐতিহাসিক জর্জ রুডে মনে করেন এই প্রথা ছিল বুমেরাঙের মত, আক্রান্তের চেয়ে আক্রমণকারী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এই প্রথা কার্যকর করতে গিয়ে নেপোলিয়ন স্পেন ও পর্তুগাল আক্রমণ করেন। স্পেনীয় যুদ্ধ শেষ না করে তিনি রাশিয়া আক্রমণ করেন। মহাদেশীয় প্রথা থেকে যে রাজনৈতিক ও সামরিক ঘটনাপ্রবাহ শুরু হয়েছিল তা পর্তুগাল ও রাশিয়ার মধ্য দিয়ে নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পতনে পরিণতি লাভ করেছিল।
The Continental System and the Fall of Napoleon
Napoleon’s principal enemy was England. Between 1805 and 1807, Napoleon succeeded in subduing almost all his European rivals, but England remained unconquered. In the early years, Napoleon attempted to defeat England through direct military invasion. However, in the Battle of Trafalgar in 1805, the combined naval forces of France and Spain were not only defeated but virtually destroyed by the British navy. After this disaster, Napoleon abandoned the idea of a direct attack on England and instead adopted an economic strategy against her, known as the Continental System.
Napoleon introduced the Continental System with a dual objective: to destroy the British economy and to promote the growth of the French economy. The chief source of Britain’s strength lay in her colonial empire and vast commercial wealth. European countries were the principal markets for British-manufactured goods. Napoleon believed that if British goods were excluded from European ports, Britain’s trade would collapse and her economy would break down. At the same time, if these importing countries purchased their required goods from France instead, French industry would flourish, and the bourgeoisie of France would become the main supporters of Napoleon’s autocratic regime.
The first major step of the Continental System was the Berlin Decree of 1806. By this decree, Napoleon declared the British Isles to be under blockade and prohibited France, its allies, and even neutral countries from trading with Britain. Any goods sent from Britain to Europe or from Europe to Britain were to be confiscated by France. Austria and Russia accepted these restrictions under the Treaty of Tilsit. In retaliation, Britain issued the Orders in Council in 1807, declaring that neutral countries wishing to trade with Europe must obtain licences from British authorities by paying appropriate duties; otherwise, British naval forces would seize their merchant ships. In response, Napoleon issued the Milan Decree in December of the same year, announcing that any ship that accepted a British licence would be treated as British property and confiscated. The Fontainebleau Decree further declared that such confiscated ships would be publicly burnt.
Napoleon launched an economic war against England, but he lacked a navy strong enough to police Europe’s vast coastline effectively. Moreover, to compel reluctant states to obey the Continental System, he was forced to resort to war. Despite these efforts, Britain did not suffer severe long-term damage. Britain adopted a strategy to keep the markets of Northern Europe open and, by repeatedly attacking Copenhagen, maintained her trade in the Baltic region. Although Napoleon attempted to stop Britain’s trade with neutral countries, British goods continued to reach European markets through smuggling, as there was a strong demand for them. However, the Orders in Council temporarily angered neutral countries, especially the United States. When British trade with Europe declined, Britain was compelled to adopt a more flexible licensing policy.
By around 1810–12, the Continental System had some impact on Britain’s economy. In 1811, Britain experienced industrial decline, food shortages, unemployment, wage reductions, and labour unrest, which seriously disrupted public life. Yet Napoleon failed to exploit this opportunity and even allowed the export of grain from Holland and France to England. When Russia rejected the Continental System and resumed trade with Britain, Britain’s economic difficulties eased. Except for the crisis of 1811, Britain did not face any major economic disaster. Furthermore, Britain compensated for the loss of traditional European markets by establishing new trade links with Argentina and Brazil in South America, Turkey in the Near East, and the countries along the Baltic coast.
The Continental System became one of the major reasons for the decline of Napoleon’s popularity. The demand for British-manufactured goods in European markets could not be met by French industry at the required pace. Rapid industrialisation in France was not possible, particularly because British Orders in Council had almost cut off the supply of raw materials from British colonies. As a result, shortages of manufactured goods caused widespread resentment among the European population. The economic depression of 1810–12 also turned the French bourgeoisie against Napoleon. Under popular and political pressure, Napoleon granted licences to French merchants to export goods to Britain. Since only French merchants benefited from this policy, allied states—especially Russia—became deeply dissatisfied. In 1811, Russia openly violated the Continental System. Other European countries such as the Netherlands, Switzerland, and the Baltic states also suffered under the system, while Portugal refused to accept it altogether. Consequently, anti-Napoleonic resentment spread across Europe and even within France itself.
Historian George Rudé observed that the Continental System proved to be like a boomerang—the attacker suffered more than the target. In attempting to enforce the system, Napoleon invaded Spain and Portugal, and without concluding the Spanish war, he went on to invade Russia. The chain of political and military events triggered by the Continental System ultimately culminated in Napoleon’s final downfall, passing through the disasters in Portugal and Russia.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন