সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জাবতি ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করো।

ভারতের মুঘল শাসনে রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব। মুঘল যুগে কি উপায়ে, কতটা ভূমি রাজস্ব হ আদায় করা হতো আধুনিক ইতিহাস চর্চার একটা আকর্ষণীয় বিষয়। 


বাবর ও হুমায়ুন পুরানো দিনের সুলতানি আমলের রাজস্ব ব্যবস্থাই বহাল রাখেন। জায়গিরদারী ব্যবস্থার মাধ্যমে সেই ভূমি রাজস্ব আদায় হতো। বিদেশি বিবরণ থেকে জানা যায় সকল জমির মালিক ছিল মুঘল সম্রাট। তাই ভূমি রাজস্ব ছিল ভূমির খাজনা। অন্যদিকে ইরফান হাবিব দেখিয়েছেন ভূমি রাজস্ব ছিল উৎপন্ন ফসলের উপর স্থাপিত কর, তাই উৎপাদন না হলে রাজস্ব দিতে হতো না। উৎপাদন ব্যাহত হলে রাজস্ব মুকুব এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। যাই হোক সম্রাট আকবর‌ ই প্রথম নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে টোডরমলের সাহায্য ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার আমূল সংস্কার সাধন করেন। 


আকবরের আমলে যেসব ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল সেগুলি জাবতি, নকস, গাল্লাবক্সী প্রভৃতি প্রথা। এগুলির মধ্যে যাবতীয় ব্যবস্থার জন্য মুঘল রাজস্ব ব্যবস্থা ইতিহাসে অনন্য স্থানের অধিকারী হয়ে আছেন। 


কতগুলি স্পষ্ট পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে আকবর ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা স্থির করে ১) বৃহৎ সাম্রাজ্যের সর্বত্র নির্দিষ্ট মাপের মাধ্যমে চাষযোগ্য জমি প্রতিটি কৃষকের দখল অনুযায়ী জরিপ করার ব্যবস্থা করেন ২) সমস্ত চাষযোগ্য জমি কে পোলাজ, পরোটি, চাঁচর ও বাঞ্জার উৎপাদিত শক্তি অনুযায়ী এই চার ভাগে ভাগ করা হয় ৩) প্রতি বিঘা জমির গত 10 বছরের উৎপাদিত ফসলের গড় নির্ণয় করে রাষ্ট্রের তৎকালীন দাম অনুযায়ী বার্ষিক ⅒ ভাগ রাজস্ব হিসেবে ধার্য করেন। এবং এর ⅓ অংশ সরকারকে পুরোদেগীয়.…..... রাজস্ব নির্ধারিত হয় ৪) শষ্যের পরিবর্তে নগদ অর্থে রাজস্ব রাষ্ট্রকে পরিশোধ করতে হবে, এই উদ্দেশ্যে আকবর তার সাম্রাজ্যকে কতগুলি দপ্তরে ভাগ করে এবং প্রতিটি দপ্তরে শষ্যের একই মূল্যমান রাখা হয়, উপরোক্ত হিসাবে প্রতিটি চাষীর কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করা হত। তাই চাষী যেটুকু জমি চাষ করত তারই রাজস্ব দিতে হতো। পাটোয়ারীরা গ্রামে গিয়ে রাজস্ব নির্ধারণ করত নগদ অর্থে প্রদেয় রাজস্বে দাবি পত্র ধরিয়ে দিত। চাষীরা ইচ্ছা করলে নগদ অর্থের বদলে শষ্যের মাধ্যমে রাজস্ব দিতে পারতো। তবে রশিদ দেওয়া হতো নগদ অর্থের হিসাবে। 


টোডারমল এই ব্যবস্থার পূর্বে হস্ত ও বুদ নামক রাজস্ব ব্যবস্থা পরিচালিত করেছিল। এই ব্যবস্থা উৎপন্ন সর্ষের প্রকৃত পরিমাপ হিসেব করে আসল ফসল অনুমান করা হতো। কানুনগো রা জমা নির্ধারণ করতেন। তখন টোডারমল কে গুজরাটের রাজস্ব বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। টোডরমল তার জাবতি ব্যবস্থা গুজরাটে সফল হন তখন তাকে সমগ্র সাম্রাজ্যের রাজস্ব সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাষ্ট্র সকল জায়গীর বায়োজাপ্ত করে। বাংলা বিহার উড়িষ্যা বাদে বাকি সব জমি খালিশার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সমগ্র সাম্রাজ্যকে ১৮১ টি পরগনায় বিভক্ত করে প্রত্যেক পরগনায় ক্রোবি নামক রাজস্ব অধিকারী নিয়োগ করা হতো। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে টোডরমল দেওয়ান- ই- আসরাফ পদে নিযুক্ত হবার পর গুজরাটে দশশালা বন্দোবস্ত সারা সাম্রাজ্যের উপর প্রয়োগ করেন। তখন থেকেই এই জাবতি ব্যবস্থাই মুঘল রাজস্ব ব্যবস্থার ভিত্তি হয়ে পড়ে। 

জাবতি ব্যবস্থাকে মুঘল রাজস্ব ব্যবস্থার ভিত্তি বলা যায়। তবে সমগ্র মুঘল যুগে একই রকম রাজস্ব নীতি অবলম্বিত হতো না। এমনকি একই হারে রাজস্ব আদায় হতো না। এন এ সিদ্দিকী দেখিয়েছেন আকবরের সময় উৎপন্ন শস্যের ⅓ ভাগ রাজস্ব ধার্য ছিল। তবে যেখানে জাবতি ব্যবস্থা পরিচালিত ছিল সেখানে ⅓ অংশ রাজস্ব আদায় হতো। তবে যেখানে নকস, ব্যবস্থা পরিচালিত ছিল সেখানে কি রকম রাজস্ব আদায় হতো তার মাসিক তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...