সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা কর।

 মারাঠা জাতি তথা ভারতের ইতিহাসে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ একটি নির্ণয় কারী ঘটনা। পেশোয়া বালাজি বাজিরাও পাঞ্জাব দখল করলে আফগান বীর আহমদ শাহ আবদালির সঙ্গে মারাঠাদের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। আবদালি ১৭৫৮ তে পাঞ্জাব পুনঃ দখল করে দিল্লির দিকে এগিয়ে যান পথে বালাজি বাজিরাও তার পুত্র বিশ্বাস‌ রাও ও ভাই সদাশিব রাও এর নেতৃত্বে বিরাট বাহিনী আহমদ শাহ আবদালিকে বাধা দেওয়ার জন্য প্রেরণ করেন। মারাঠা সেনাপতি উত্তর ভারতের হিন্দু রাজাদের সাহায্য চেয়েছিলেন কিন্তু সাড়া পাননি। মারাঠারা দিল্লি দখল করলে আবদালি ও দিল্লির দিকে অগ্রসর হয় ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত পানিপথের যুদ্ধে নিঃসঙ্গ মারাটা বাহিনী পরাজিত হয়। যুদ্ধে বিপাণ চন্দ্রের মতে ২৪ হাজার মারাঠা সেনা ও ২২ জন প্রধান সেনাপতি মারা যায়। বিশ্বাস রাও ও সদাশিব রাও এর মৃত্যু ঘটে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বালাজি বাজিরাও ওই বছরেই মারা যান।


পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের গুরুত্ব নিরুপমে ঐতিহাসিকরা তীব্র বিতর্কে জড়িয়েছেন। মারাঠা ঐতিহাসিকরা এই যুদ্ধকে গুরুত্বহীন ঘটনা হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। তাদের মতে কয়েকজন প্রথম সারির মারাঠা সামরিক নেতা ছাড়া মারাঠা শক্তি কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এই যুদ্ধের ফলে মারাঠা শক্তি ধ্বংসও হয়নি কারণ অল্প কালের মধ্যে মাধব রাও নানা ফডনবিশ, মহাদজি সিন্ধিয়া প্রভৃতির নেতৃত্বে মারাঠারা সংগঠিত হয়েছিল এবং তৎকালীন অষ্টাদশ শতকীয় রাজনীতিতে যে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। তার প্রমাণ মহাদজি সিন্ধিয়ার ১৭৮৮ সালে দিল্লি দখল করে মুঘল সম্রাট কে নিয়ন্ত্রণে আনা। তাই জি এস সারদেশাই তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধকে বিপর্যয় বলেছেন।


ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার মনে করেন মারাটা ঐতিহাসিকের উক্ত বক্তব্য উগ্র স্বদেশীকতা দ্বারা পরিচালিত। তাঁর মতে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ ছিল মারাঠা জাতির বিপর্যয় এমন কোন পরিবার ছিল না যেখানে একজন সদস্যেরও মৃত্যু হয়নি। একটি গোটা প্রজন্মের নেতৃত্ব একটি আঘাতেই নির্মূল হয়ে গেছিল। ভারতের ইতিহাস কিভাবে প্রভাবিত করে তা পানিপথ নির্ধারিত করে দিয়েছিল। কালী কিংকর দত্ত মনে করেন পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ মারাটা সাম্রাজ্যবাদের গতিকে সম্পন্ন ভিন্ন খাতে পরিণত করেছিল।

নিরপেক্ষ হবে দেখলে বোঝা যায় সারদেশাই প্রমুখ মারাটা ঐতিহাসিকরা ইচ্ছাকৃতভাবে এই যুদ্ধের গুরুত্বকে ছোট করে দেখিয়েছেন। স্টুয়ার্ট গর্ডন তার the Marathas গ্রন্থে বলেছেন মারাঠারা যেসব অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত সেই সব অঞ্চলেই পানিপথের মারাত্মক কুফল অনুভূত হয়েছিল। মারাঠা শক্তির মর্যাদা অনেকাংশ ক্ষুন্ন হয়েছিল। মুঘলদের পতনের পর মারাঠা যে গোটা ভারতবর্ষের শাসক হচ্ছেনা এ সত্য স্পষ্ট হয়ে গেছিল। তাই বিপণচন্দ্রের মতে "the third battle of Panipat did not decide who was to rule India but rather who was not"

এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে এই যুদ্ধে মারাঠাদের পরাজয় ইংরেজ শক্তির উৎখানের পথ প্রশস্ত করেছিল।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...