সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইঙ্গ ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণ ও পরিণাম সংক্ষেপে আলোচনা কর।

ইংরেজ ও ফরাসি এই দুই ইউরোপীয় শক্তি উপনিবেশিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভারতে আসেন এবং ভারতের বাণিজ্য ও সম্পদের উপর নিজেদের একছত্র অধিপত্য স্থাপন করার চেষ্টায় একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। করমন্ডল উপকূল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় অর্থাৎ কর্ণাটক এলাকা ১৭৪৪ থেকে ১৭৬৩ পর্যন্ত তিনটি যুদ্ধ হয়। যা পর্যায়ক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ নামে পরিচিত। 


মুঘল সাম্রাজ্যের পতনে, দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক অস্থিরতায় ইংরেজ ও ফরাসিরা তাদের স্বার্থসিদ্ধির সুযোগ পেয়েছিল। হায়দ্রাবাদী নিজাম উল মুল্ক আসফ ঝাঁ এর মৃত্যুর পর সমগ্র দক্ষিণ ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, তার উপর মারাঠাদের আক্রমণকে ব্যতিব্যস্ত করে। এই অবস্থায় ইংরেজ ও ফরাসিরা পারস্পারিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়। যাতে করে করমন্ডল উপকূলে বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারলে ভারতে সাম্রাজ্যের স্থাপনের কাজ সহজ হবে। তাছাড়া ১৭৪০ নাগাদ অস্ট্রিয়ায় উত্তরাধিকার নিয়ে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভারতে এই দুই বনিক গোষ্ঠীকে প্ররোচিত করেছিল। 


অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার দ্বন্দ্ব শুরু হলেও ফরাসি কিংবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে লড়াইয়ে নামতে চাইনি। তবে প্রথম গোলমালটা ইংরেজরায় বাঁধিয়েছিল। ইংরেজ সেনাপতিরা কয়েকটি জাহাজ দখল করে নিলে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ শুরু হয়। মরিশাস থেকে লা বুর্দনের নেতৃত্বে ফরাসিদের জন্য নৌবাহিনী আসে ফলে ফরাসিদের অবস্থান শক্ত হয়। মাদ্রাজে ইংরেজদের উপর আক্রমণ হলে ইংরেজরা আত্মসমর্পণ করে ফরাসিরা মাদ্রাজ ছিনিয়ে নেয়। নিরাপত্তার জন্য ইংরেজরা কর্ণাটকের নবাব আনোয়ার উদ্দিন এর কাছে আবেদন করে এবং সাড়াও পায়। যদিও ফরাসিরা নবাবের বাহিনীকে হারিয়ে দেয়। ইতিমধ্যে মাদ্রাজ থেকে লুণ্ঠিত সামগ্রীর ভাগ নিয়ে ফরাসি গভর্নর ডুপ্লে ও লা বুর্দনের মধ্যে ঝগড়া করায় ফরাসি শিবির দুর্বল হয়ে যায়। লা বুর্দনে মারিশাস ফিরে যান 1746 খ্রিস্টাব্দে ডুপ্লে দ্বিতীয়বার সেন্ড ডেবিট ফোর্ট অধিকারের চেষ্টা করেন। আই লা শ্যাপেল এর সন্ধি অনুযায়ী ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটলে ভারতেও প্রথম ইঙ্গ ফরাসি দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। ভারতে ইংরেজরা তাদের হারানো এলাকা ফিরে পায়, ফরাসিরাও উত্তর আমেরিকায়। 


আপাতদৃষ্টিতে প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধ ভারতের রাজনীতিতে কোন পরিবর্তন না আনলেও এর দ্বারা শৃঙ্খলবদ্ধ ক্ষুদ্র ইউরোপীয় বাহিনীর কাছে নবাবের সমস্যাবহুল অদক্ষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপদার্থতা প্রতীয়মান হয় এবং প্রমাণ করে যে ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে হলে শক্তিশালী নৌবাহিনী অবশ্যক।


১৭৪৮ নাগাদ কর্নাটকের ও হায়দ্রাবাদের সিংহাসনের উত্তরাধিকার সমস্যা কে কেন্দ্র করে দ্বিতীয়বার ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। ফরাসিরা কর্ণাটকের চাঁদা সাহেব এবং হায়দ্রাবাদের মুজাফফর জঙ্গ কে সমর্থন করে আর ইংরেজরা সমর্থন করে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী কর্নাটকের আনোয়ার উদ্দিন এবং হায়দ্রাবাদের নাসির জঙ্গ কে, ফরাসি সমর্থনপুষ্ট দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিজয়ী হন। হায়দ্রাবাদের নতুন নিজাম হন মুজাফফর জঙ্গ তিনি নর্দান সরকার ও মুসলিপত্তনামে ফরাসিদের জন্য একটি জায়গীর মঞ্জুর করেন। পন্ডিচেরির আশেপাশে কিছু গ্রামও দান করা হয় দরবারে একজন ফরাসি প্রতিনিধি নিয়োজিত হয়। 


ফরাসিদের শক্তি বৃদ্ধিতে ইংরেজরা সতর্ক হয়, রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে কলকাতা থেকে শক্তিশালী বাহিনী মাদ্রাজে আসে 1752 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় কর্নাটকে যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হয়। ক্লাইফ আর্কট দখল করেন, মোহাম্মদ আলী কে মুক্ত করে কর্নাটকের সিংহাসনে বসান। ইতিমধ্যে কর্ণাটকের যুদ্ধে অনেক ক্ষয়ক্ষতি ঘটায় ফরাসি সরকার ডুপ্লেকে ডেকে পাঠায়। নতুন গভর্নর হয়ে আসে গেদেহিউ। গেদেহিউ ইংরেজদের সাথে সন্ধি করে শর্তানুযায়ী পন্ডিচেরির আশেপাশে অঞ্চল ফরাসিদের অধিকার স্বীকৃত হয়। 


১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ আরম্ভ হলে ভারতে পুনরায় ইঙ্গ ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। এবার ছিল হেস্ত নেস্ত করার পালা ।এই যুদ্ধ কেবল দাক্ষিণাত্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বঙ্গদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গদেশ থেকেই এর সূচনা, ক্লাইভ ফরাসি কুঠী চন্দননগর দখল করেন। প্রথম থেকেই ফরাসি সরকারের উদাসীনতা, ফরাসিদের আর্থিক দুর্বলতা তাদেরকে পিছিয়ে রেখেছিল। কাউন্ট ল্যালির নেতৃত্বে শক্তিশালী বাহিনী পাঠানো হলেও ফরাসিরা একের পর এক যুদ্ধ হেরে যায়। বাংলার চন্দননগর প্রথমেই হাতছাড়া হয়ে যায়। কর্নাটকে প্রায় সব কটি ঘাটি ধ্বংস হয়। শেষে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে বন্দিবাসের যুদ্ধে ফরাসিরা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় এবং আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। ইতিমধ্যে প্যারিসের সন্ধির দ্বারা সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অবসান ঘটলে, ভারতেও ইঙ্গ ফরাসি দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে, ফরাসিরা শর্ত সাপেক্ষ তাদের পুরানো কুঠি গুলি ফিরে পায়। শর্ত ছিল ফরাসিরা কখনোই চন্দননগর কে সুরক্ষিত করতে পারবে না। ইতিমধ্যে ইংরেজরা তাদের প্রভাবসীমা বাড়িয়ে নেয়। ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবসা পত্র গুটিয়ে ভারতবর্ষ থেকে চলে যায়। সেইসঙ্গে ইংরেজদের প্রধান ইউরোপীয় প্রতিদ্বন্দ্বী।


দাক্ষিণাত্যে প্রায় দুই শতক ধরে চলে আশা ইঙ্গ ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিণতিতে ইংরেজরাই লাভবান হয়। ফরাসিদের আর কোন ক্ষমতায় রইল না কার্যত তারা ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিণত হয়। অন্যদিকে ফরাসিদের পরাজয় ও তাদের বিদায়ের অবসরে ইংরেজরা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কর্ণাটক ও হায়দ্রাবাদ তাদের হস্তগত হয়, ভারতের উপকূলীয় বাণিজ্যে তাদের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রমেশ চন্দ্র মজুমদারের ভাষায় এই সংগ্রাম নিশ্চিতভাবে স্থির করে দিয়েছিল ফরাসিরা নয় ইংরেজরাই ভারতবর্ষে প্রভুত্ব করতে চলেছে।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...