সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ফ্রান্সে অভিজাত বিদ্রোহ | The Aristocratic Revolt in France

ফ্রান্সে অভিজাত বিদ্রোহ

ফরাসি বিপ্লবকে বুর্জোয়া বিপ্লব বলা হলেও, এই বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল অভিজাতদের দ্বারা। জর্জ লেফেভর অভিজাতদের বিদ্রোহ কে 'অভিজাত বিপ্লব' বলেছেন। বিপ্লবের প্রাক্কালে রাজকোষে চরম সংকট দেখা দিয়েছিল তার থেকে উত্তরনের জন্য ফরাসী সম্রাট বেশ কিছু সংস্কার প্রবর্তন করার চেষ্টা করেছিলেন, যেগুলো দ্বিতীয় এস্টেট বা অভিজাতদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছিল। এজন্যই অভিজাতরা রাজার বিরোধিতা করেছিলেন। তবে এর সঙ্গে ফরাসী বিপ্লবের মূল আদর্শ সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার কোন যোগ ছিল না। 

১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি অর্থনীতির দায়িত্ব নিয়ে কালোন অভিজাত ও যাজকদের করের আওতায় নিয়ে আসার জন্য বিশদ পরিকল্পনা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ন্যায্য কর নীতির প্রবর্তন করা এবং পর্যায়ক্রমে এমন একটি কর ব্যবস্থা চালু করা হবে, যার ফলে সম্পদশালীদের করের অতিরিক্ত বোঝা বইতে হবে। তিনি টাইল ও গ্যাবেলের ভার লাঘব এবং বেগার প্রথা বা কার্ভির প্রচলন কমানোর কথা বলেন। কালোন সরকারি ব্যয় হ্রাস ও স্ট্যাম্পশুল্ক ব্যাপক বিস্তৃত করার কথাও বলেন। এছাড়া তিনি ফ্রান্সের স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও আমূল পরিবর্তনের কথা বলেন। অ্যালবার্ট গুডউইন লিখেছেন, "কালোনের সংস্কার নতুন কার্যকর বিকেন্দ্রীকরণ চেয়েছিল"। কিন্তু কালোনের এই সমস্ত পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিরোধিতা দেখা দিলে ১৭৮৭ সালে কালোণকে পদচ্যুত করে তুলোঁর আর্চবিশপ লোমেনিক ব্রীনী কে তাঁর স্থানে আনেন ষোড়শ লুই।

ব্রীনী কালোনের বিরোধী হলেও তিনি অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব গ্রহণের পর, অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য যে প্রস্তাব দেন তার সঙ্গে কালোনের প্রস্তাবের বিশেষ পার্থক্য ছিল না। তাই ব্রীনী গণ্যমান্যদের সভায় তার প্রস্তাব পেশ করলে সভা তা মানতে অস্বীকার করে। এই পরিস্থিতিতে ব্রীনী পার্লামেন্টের মুখোমুখি হতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত ফরাসি সরকার পার্লামেন্টকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, ১৭৯২ সালে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকা হবে। এই পরিস্থিতিতে ১৭৮৭-৮৮ সালে রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্রের সঙ্ঘাত চরমে পৌঁছায়, ফ্রান্সের প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ শহরে দাঙ্গার সূচনা হয়। ১৭৮৮ সালের ৭ই জুলাই গ্রেনোবিলে সৈন্য মোতায়েন করে পার্লামেন্ট কে দমন করার প্রয়াস চালানো হলে নাগরিকরা টালি ছুড়ে  সামরিক বাহিনীকে তাড়িয়ে দেয়, যা ইতিহাসে 'টালি দিবস' নামেও পরিচিত। আগস্ট মাসে রাজা ব্রিনীকে মন্ত্রিত্বের পদ থেকে আপসারিত করেন এবং নেকারকে পুনরায় অরথমন্ত্রকের দায়িত্ত্ব  দেন। রাজার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অভিজাততন্ত্র জয়যুক্ত হয়। 

অভিজাততান্ত্রিক বিপ্লব ফ্রান্সের স্থির নিস্তরঙ্গ সমাজকে সজোরে আঘাত করেছিল। অভিজাত বিদ্রোহ রাজতন্ত্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে ছিল।  ১৭৮৯ সালে মে মাসে স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আহবান করা হলে এই রাজতন্ত্র বিরোধী হাতিয়ার হাতে তুলে নিয়েছিল অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল বুর্জোয়ারা ।.এরা রাজার বিরোধিতায় অভিজাতদের কৌশলই অবলম্বন করেছিল। তাই ঐতিহাসিক জর্জ রুদে অত্যন্ত সঠিকভাবেই বলেছেন, ফ্রান্সের অভিজাত বিদ্রোহ ছিল ফরাসি বিপ্লবের Curtain raiser.

The Aristocratic Revolt in France

Although the French Revolution is described as a bourgeois revolution, its initial phase was led by the aristocracy. Georges Lefebvre termed this aristocratic uprising the “Aristocratic Revolution.” On the eve of the Revolution, the French treasury was facing a severe financial crisis. In order to overcome this crisis, the French king attempted to introduce several reforms, many of which went against the interests of the Second Estate, that is, the nobility. For this reason, the aristocrats opposed the king. However, this opposition had no connection with the core ideals of the French Revolution—liberty, equality, and fraternity.

In 1783, Calonne, who took charge of the French finances, prepared a detailed plan to bring the nobility and the clergy under the tax net. His objective was to introduce a fair system of taxation and gradually establish a structure in which the wealthy would bear a greater share of the tax burden. He proposed reducing the burden of the taille and the gabelle, and limiting the practice of forced labour or corvée. Calonne also advocated a reduction in government expenditure and a wide extension of stamp duties. In addition, he proposed radical changes in France’s system of local administration. Albert Goodwin wrote that “Calonne’s reforms demanded a new and effective decentralisation.” However, when strong opposition arose against these proposals, Louis XVI dismissed Calonne in 1787 and appointed Loménie de Brienne, the Archbishop of Toulouse, in his place.

Although Brienne had opposed Calonne, after assuming charge of the finance ministry, he proposed measures to resolve the economic crisis that were not significantly different from those of Calonne. When Brienne placed his proposals before the Assembly of Notables, it refused to accept them. Under these circumstances, Brienne was forced to confront the Parlement. Eventually, the French government promised the Parlement that the Estates-General would be convened in 1792. As a result, during 1787–88, the conflict between the monarchy and the aristocracy reached its peak, and riots broke out in almost all major cities of France. On 7 July 1788, when troops were deployed in Grenoble to suppress the Parlement, the citizens drove away the soldiers by hurling roof tiles at them—an incident that came to be known in history as the “Day of Tiles.” In August, the king dismissed Brienne from office and reappointed Necker as finance minister. All efforts of the king failed, and the aristocracy emerged victorious.

The aristocratic revolution delivered a powerful blow to the previously stable and placid structure of French society. The aristocratic revolt directly challenged the absolute authority of the monarchy. When the Estates-General was finally convened in May 1789, this anti-monarchical weapon was taken up by the comparatively progressive bourgeoisie, who adopted the same strategies that the aristocrats had earlier used against the king. Hence, the historian George Rudé aptly remarked that the aristocratic revolt in France was the “curtain raiser” of the French Revolution.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...