সম্রাট আকবর সরকারি কর্মচারীদের সুসংগঠিত করার জন্য মনসবদারি ব্যবস্থা চালু করে। তখন থেকেই মনসবদাররা মুঘল শাসনব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। মনসবদারদের কিছু নগদ বেতন পেত। আর কিছু মনসবদার জমির অধিকার পেতো এরা জায়গীরদার নামে পরিচিত। জায়গীরদার রা তাদের জায়গীর থেকে রাষ্ট্র নির্ধারিত সমস্ত কর আদায় করতো। জায়গীর বাদে সম্রাটের অধীনস্থ কিছু খালিশা জমি ও কিছু পাইবাকি জমি অর্থাৎ যেগুলি তখনও মনসবদারের কাছে বণ্ঠিত হয়নি এমন কিছু জমি ছিল সাম্রাজ্যের। বেশিরভাগ জমি ই ছিল জায়গীরদারী জমি বন্ঠিত। ভূমির উপর জায়গীরদারদের কোন ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। সম্রাটের ইচ্ছামত তাদের বদলি করা যেত এমন জায়গির তনখা জায়গীর নামে পরিচিত। আর যে জায়গীর গুলি বংশানুক্রমিকভাবে ভোগ করা যেত তাকে ওয়াতন জায়গীর বলা হত।
তনখা জায়গির গুলির বদলির রীতি কিরূপ জটিলতার সৃষ্টি করেছিল তা দেখিয়েছেন ইরফান হাবিব। কোন জায়গীরদার যে অঞ্চলে থাকতো সেখানে সেই সময়ে ভালো উৎপাদন না হলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। বছরে যেকোনো সময়ই জায়গীরদারদের বদলি করা হতো। তখন একই অঞ্চলে নতুন ও পুরানো দুই জায়গীরদারদের রাজস্ব আদাই করতে হতো। কারণ যে জায়গীরদার যে অঞ্চলে যত মাস থাকতো তত মাসের রাজস্ব তাকে সম্রাটকে দিতে হতো। তাছাড়া মনসব লাভের সাথে বা পদোন্নতির সাথে সাথে যারা জায়গীর পেয়ে যেতেন তারা সম্রাটের কাছ থেকে ব্যয় নির্বাহের জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে টাকা চাইতে পারতো, কিন্তু ঔরঙ্গজেব নিয়ম বন্ধ করেন। জায়গীরদারদের বদলির নীতি ও তাদের আয়ের অনিশ্চয়তা তাদেরকে কৃষকদের অত্যাচারের মাধ্যমে বেশি করে রাজস্ব আদায়ের তৎপর করে। ঔরঙ্গজেব প্রথমদিকে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার দিকে নজর দিতেন। অত্যাচারী জায়গীরদারদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে। কিন্তু রাজত্বের শেষ বছর গুলিতে মারাঠা শক্তিকে দমন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। যে দু দশক দাক্ষিণাত্যে অতিবাহিত করেন ফলে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং অযোধ্যা, পাঞ্জাব প্রভৃতি অঞ্চলের জমিদার, কৃষক অভ্যুত্থান মুঘল সাম্রাজ্যের তীব্র সংকটের সৃষ্টি করেছিল।
ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে অভিযানের সময় তার বিরোধীদের মুঘল শাসনতন্ত্রে অঙ্গীভূত করার জন্য এবং দক্ষিণী রাজ্যগুলির উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিনষ্ট করার জন্য উদার হাতে মনসব বন্টন করেছিলেন। ১৬৫৮ থেকে ৭৮ এর মধ্যে এক হাজার বা তার বেশি জাট সম্পূর্ণ মারাঠা মনসবদারদের সংখ্যা ২৭ থেকে বেড়ে হয় 96 আর ১৬৭৯ থেকে ১৭০৭ এর মধ্যে ১০০০ বা তারই বেশি জাট সম্পূর্ণ মুসলিম মনসবদারদের সংখ্যা বেড়ে হয় ১৩৫ থেকে ১৬১। নবনিযুক্ত দক্ষিনী মনসবদারদের যারা দাক্ষিণাত্যে জায়গীর পেতো তাদের আর্থিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। আবার যে সময় দক্ষিণী মনসবদারদের উত্তর ভারতে জায়গীর পেতে লাগলো তারা পুরানো মনসবদারদের ঈর্ষার পাত্র হয়ে ওঠল। দক্ষিণী মনসবদারদের নিযুক্তির ফলে মারাঠা মনসবদারদের সংখ্যা রাজপুতদের চেয়ে বেড়ে যায়। আবার বিজাপুরী আফগানদের সংখ্যা সৈয়দ, তুরানি ও ইরানি দের চেয়ে বেড়ে যায়। আবুল ফজল লিখেছেন নতুন মনসবদার নিযুক্তির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল খানজাদা অর্থাৎ পুরনো মনসবদারদের সন্তানরা তাই তারা বিক্ষুদ্ধ হয়েছিল। ঔরঙ্গজেব এই সমস্যার সমাধানের জন্য ঘোষণা করেন দক্ষিণী মনসবদারদের কেবল দক্ষিণ ভারতেই জায়গীর দেওয়া হবে। এতে সমস্যার সমাধান হলো না। কারণ দাক্ষিণাত্যে বরাবরই ঘাটতি ছিল। তাছাড়া দক্ষিণ ভারতে অ দক্ষিণী মনসবদারদের সংখ্যা এত বেশি ছিল যে নতুন দক্ষিণী মনসবদারদের উত্তর ভারতে জায়গীর না দিয়ে উপায় ছিল না।
এই সময় চরম আর্থিক সংকট দেখা দেয় মারাঠাদের উত্থান এবং বারংবার মুঘল প্রদেশ গুলিতে বিশেষত শহর ও বন্দর গুলিতে আক্রমণ ও লুণ্ঠন আর্থিক সংকটকে তীব্রতর করে তুলেছিল। এই আক্রমণ এর মোকাবিলা করার জন্য অশ্ব, জনবল ও সম্পদ তখন মুঘল কর্মচারীদের ছিল না। তাছাড়া সেই সময় প্রচুর দক্ষিণী মুঘল মনসবদার মারাঠাদের পক্ষে যোগদান করেছিল। তাছাড়া ওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য অভিযানের খরচের চাপ অর্থনৈতিক সংকটকে মারাত্মক করেছিল। এই অর্থনৈতিক সংকট সাংগঠনিক কাঠামোকে দুর্বল করে তোলে। সতীশ চন্দ্র লিখেছেন শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার ব্যয়, যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং অভিজাতদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় মিটানোর মত যথেষ্ট সামাজিক উদ্বৃত্ত সে সময় ছিল না। মুদ্রামুল্য হ্রাস পাওয়ায় বিলাস সামগ্রীর ব্যয় এত বাড়ে যে অভিযাতরা ক্রমবর্ধন চাহিদা মেটাতে পারে না। কারণ চাহিদা হারে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি। এই অবস্থায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাংগঠনিক দুর্বলতা জনিত কারণে হাসিলের পরিমাণ জমা অপেক্ষা অনেক কমে যায়। আবার উৎকৃষ্ট পাইবাকি জমির পরিমাণও কমতে থাকে। তার ওপর ঔরঙ্গজেব নতুন মনসব প্রদানও করে ফলে মনসবদারদের মধ্যে সীমিত পরিমাণ জায়গীর এর জন্য রেষারেষি ও প্রতিযোগিতা এক নজিরবিহীন সংকটের সৃষ্টি করেছিল। জায়গীর এর অসম বন্টন ও মুষ্টিমেয় মনসবদারদের হাতে সম্পদের ভারসাম্যহীন কেন্দ্রীকরণ এই সংকটকে তীব্র করেছিল।
জায়গীরদার রা তাদের বর্ধিত চাহিদা মেটাতে বেশি করে রাজস্ব আদায়ের বর্ধপরিকর হয়। তারা কৃষকদের উপর জোর জবরদস্তি করে বেশি করে রাজস্ব আদায় করতে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবে ভূমি ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চাপে পড়ে কৃষক জমি ছেড়ে চলে যেতেন। জমিদার ও কৃষকরা একত্রে মুঘল বিরোধী বিদ্রোহের যোগ দেয় ফলে মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। ওরঙ্গজেবের জীবন দশাতেই অযোধ্যার বাইশওয়ারা অঞ্চলের জমিদাররা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। মুঘল বিরোধী জমিদার, কৃষক অভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠেছিল পাঞ্জাব। জাট জমিদারেরা শিখ নেতা বান্দা বাহাদুরের সাথে হাত মিলিয়ে বিদ্রোহে নামে। মুঘল সম্রাট শতচেষ্টা করেও বিদ্রোহ গুলি দমন করতে পারিনি।
উৎকৃষ্ট ও উর্বর জমি জায়গীর হিসেবে লাভ করার জন্য মনসবদারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা, বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্য জায়গীরদারদের জমি থেকে ক্রমবর্ধমান চাহিদা। তাদের আয় বৃদ্ধির জন্য জমিদার ও কৃষকদের উপর অসম্ভব চাপ সৃষ্টির কারণে মুঘল ভারতে কৃষি সংকট মাথা চড়া দিয়ে ওঠে। কৃষি সংকটের পরিণতি হিসেবে একের পর এক বিদ্রোহ মুঘল যুগে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আছড়ে পড়েছিল। এই বিদ্রোহ গুলি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পথ প্রশস্ত করেছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন