দেওয়ানী ব্যবস্থা ভারতে মুসলমান শাসন পদ্ধতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিটি প্রদেশে সরকারি ক্ষমতা দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। দেওয়ানী ও নাজিম। প্রথমটির অধীনে ছিল রাজস্ব আদায় ও দেওয়ানির মামলা। দ্বিতীয়টির অধীনে ছিল শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা ও ফৌজদারি মামলা। তবে মুঘল শাসনের শেষ দিকে এই দুই ক্ষমতা একই ব্যক্তির হাতে চলে আসে। নবাব আলীবর্দী খাঁ একাই ছিলেন বাংলার দেওয়ান ও নাজিম। ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভ করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একরকম বাংলা, অযোধ্যা ও দিল্লি কে পরাস্ত করে উত্তর ভারত পর্যন্ত ক্ষমতা বিস্তার করেছিল। বাংলা সম্পর্কে পদক্ষেপই ছিল দেওয়ানির অধিকার আদায় যা সমকালীন বাংলা তথা ভারতের রাজনীতি অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
মীরজাফর যিনি বক্সারের যুদ্ধের পর কিছুদিনের জন্য বাংলার নবাব হয়েছিলেন তার মৃত্যু ঘটলে তার পুত্র নিজামউদ্দৌলা বাংলার নবাব হন। প্রচুর অর্থ কোম্পানিকে দিয়ে নবাব ও কোম্পানির মাঝে কোম্পানি মনোনীত একজন নায়েব সুবা নিয়োগ করা হয়। যার মাধ্যমে কোম্পানি তার শাসনতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সুবিধাগুলি আদায় করে নেবে।
বক্সারের যুদ্ধের কিছুকাল পর রবার্ট ক্লাইভ ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে কলকাতায় দ্বিতীয়বার গভর্নর হিসেবে আসার পর তার সামনে মূল রাজনৈতিক সমস্যা ছিল বাংলার নবাব ও মুঘল সম্রাটের সঙ্গে কোম্পানির ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণ করা। তিনি মনে করতেন মুঘল সম্রাটই আইনত সমগ্র ভারতের অধীশ্বর। তাই তার নাম, ছায়াকে পর্যন্ত সম্মান দেখানো দরকার। আর তাই বক্সারের যুদ্ধের পর বাংলার উপর কোম্পানির যে অধিপত্য স্থাপিত হয়েছিল তাকে আইনানুগ করতে হলে মুঘল সম্রাটের অনুমোদন প্রয়োজন।
ক্লাইভের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল বাংলার নবাব কে হাতের পুতুল করে রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করা। বক্সারের যুদ্ধে অযোধ্যা ও দিল্লী পরাজিত হলেও ক্লাইভ বেশিদূর এগোতে চাননি বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চেয়েছিল।
ক্লাইভ প্রথমে অযোধ্যার নবাব সুজা উদ দৌলার সাথে এলাহাবাদের প্রথম সন্ধি করেন ফলে অযোধ্যা কে তার নবাবের হাতেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বিনিময়ে নবাব কে ইংরেজদের ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। এহালাবাদ ও কারা নামক দুটি প্রদেশও মুঘল সম্রাট শাহ আলমকে অর্পণ করতে চুক্তিবদ্ধ হন। অযোধ্যার পর মুঘল সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে ক্লাইভ এহালাবাদের দ্বিতীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত করেন। শর্তানুযায়ী কোম্পানি কর্তৃক শাহ আলমের ক্ষমতা ও মর্যাদা স্বীকৃত হয় এবং কারা ও এহালাবাদ সম্রাট কে অর্পণ করা হয়। তার বিনিময়ে সম্রাটের নিকট হতে বছরে ২৬ লক্ষ টাকা শাহ আলমকে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানী কোম্পানি লাভ করে। এছাড়া ইংরেজরা বাংলার নবাব নজম উদ্ দৌল্লাকে বাৎসরিক ৫৩ লক্ষ টাকা ভাতা দিতে স্বীকৃত হয়।
বাংলা তথা ব্রিটিশ প্রভুত্ব স্থাপনের ইতিহাসে কোম্পানির দেওয়ানি লাভ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কাগজে-কলমে কোম্পানিকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। কার্যত এই অধিকার কোম্পানির সর্বভৌমত্বের ভিত্তিতে সুদৃঢ় করে। বাংলার নবাব নামমাত্র শাসকের পরিণত হন এবং প্রকৃত ক্ষমতা কোম্পানির হস্তাগত হয়। বাংলার নবাবের সার্বভৌম ক্ষমতার অস্তিত্ব একেবারেই বিলুপ্ত হয়। বাংলার উপর কোম্পানির ক্ষমতা আইনগত স্বীকৃত লাভ করে। দেওয়ানী লাভের ফলে বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা কোম্পানিকে সরাসরি গ্রহণ করতে না হওয়ায় কোম্পানি ইউরোপীয় অন্যান্য শক্তি গুলির ঈর্ষা থেকে রক্ষা পায়।
দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলাদেশ দুজন শাসকের অধীন হয়। নবাব পায়ে ক্ষমতাহীন দায়িত্ব, আর ইংরেজ পেল দায়িত্বহীন ক্ষমতা। এই ব্যবস্থা দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা নামে পরিচিত। এইভাবে কোম্পানি একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো।
দেওয়ানির ক্ষমতা নবাবের হাতে না থাকায় নবাবের রাজনৈতিক অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে পড়ে। নবাব সম্পূর্ণভাবে অর্থের জন্য কোম্পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সম্রাটের বার্ষিক প্রাপ্য মেটানোর পর শাসনকারীদের জন্য বরাদ্দ অর্থ ব্যয় করে বাকি রাজস্ব কোম্পানির হাতে থেকে যায়। ফলে কোম্পানির বাজেটের সমস্যা দূর হয়। সেনাবাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র বানিয়ে সামরিক শক্তি মজবুত করে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে দেওয়ানি লাভের পর থেকে বাংলায় সত্যিকারের অর্থনৈতিক নিষ্ক্রমণ শুরু হয়। কোম্পানি রাজস্ব দাবি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা দস্তকের অপব্যবহার করতে থাকে। নবাব কোম্পানির হাতের পুতুল হওয়ায় তাদের পক্ষে এই কাজ আরো সহজ হয়ে পড়েছিল। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন বাংলা থেকে পাঠানো এই অর্থেই ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল। একদিক থেকে আর্থিক নিষ্ক্রমণের ফলে চরম দরিদ্র অন্যদিকে আইন শৃঙ্খলা অবনতির ফলে জনজীবনে অরাজকতা দেখা যায় এবং এই প্রেক্ষাপটে ঘটে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর।
শাহ আলম কর্তৃক ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেওয়ানী প্রদান মুঘল ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। আকবরের সময় থেকে দেওয়ানী ও নিজামত এই দুটি বিভাগকে আলাদা করে কেন্দ্র। প্রত্যেক সুবায় একজন সুবাদার ও একজন দেওয়ান হিসেবে পৃথক ব্যক্তি কে নিয়োগ করার প্রথা, ওরঙ্গজেব পর্যন্ত কঠোরভাবে মানা হয়েছিল। কিন্তু ঔরঙ্গজেবের পর থেকে এই প্রথা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং আপাতভাবে দেখলে মনে হয় কোম্পানির হাতে দেওয়ানী দায়িত্ব তুলে দিয়ে দ্বিতীয় শাহ আলম কোন মুঘল বিরোধী কাজ করেননি। কিন্তু বিষয়টি অনুধাবন করলে দেখা যাবে যে শাহ আলম একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ান নিযুক্ত করেন। কিন্তু মুঘল ঐতিহ্য ছিল কোন ব্যক্তিকে দেওয়ান রাখা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানটি ছিল বিদেশি সুতরাং এদিক থেকে ব্রিটিশ কোম্পানিকে দেওয়ানির অধিকার দেওয়া ঐতিহ্য বিরোধী। তবে এটাও ভেবে দেখতে হবে শাহ আলম মুঘল সম্রাট হিসেবে তখন ক্ষমতাহীন ছায়ামাত্র। কোম্পানির কাছে পরাজিত হয়েছেন তাই তার পক্ষে অন্য রাস্তা ও ছিল না
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন