পানিপথের দুই যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে উত্তর ভারতের প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষেত্রে মুঘল আফগান সংঘর্ষ সম্পর্কে আলোচনা কর। মুঘল সাফল্যের কারণ দর্শাও।
ষোড়শ শতক ভারতের রাজনৈতিক পালাবদল এর কাল। গতানুগতিক ইতিহাস চর্চায় যে দীর্ঘ সময়কালকে ইসলামিক যুগ বলে আখ্যা দেওয়া হয় তারই অন্তর্গত এই পর্ব। আধ্যাত্মিক দিক থেকে মুঘল ও আফগানরা ইসলাম ধর্মালম্বী ছিলেন কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উভয় গোষ্ঠী যথেষ্ট শত্রু ভাবাপণ্য কারণ এখানে ধর্ম নয় ক্ষমতার দ্বন্দই বড়। ১৫ শতকের শেষ দিক থেকে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্য ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। লোদী সম্রাট ইব্রাহিম লোদীর সময়ে কেন্দ্রীয় শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। আফগান সদ্দার রা ইব্রাহিম লোদীর প্রতি রুষ্ট হয়ে তাকে ক্ষমতা চ্যুত করার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। রাজপুত রাও পিছিয়ে ছিল না এই পরিস্থিতিতে মধ্য এশিয়া থেকে তাড়া খাওয়া বাবরের কাছে ভাগ্যের সন্ধানে নতুন দরজা খুলে দেয়।
মঙ্গল ও তৈমুর বংশের মিশ্র বংশজাত বাবার নাবালক অবস্থায় তারই আত্মীয় শত্রুদের দ্বারা পিতৃ রাজ্য ফারঘানা রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। তার পক্ষে মধ্য এশিয়ার অটোমান, সাফাবিদ ও উজবেগ দের সাথে পেরে ওঠা সম্ভব হয়নি। সামার খন্দ দখলের আরো দুটি প্রচেষ্টা আরচিয়ান ও গজ দাওয়ানের যুদ্ধ ব্যার্থ হয় তবে কাবুলের রাজনৈতিক গৃহ বিপদের সুযোগে বাবর ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে কাবুল দখল করেন। যা ছিল তার পরবর্তীকালীন ভারত সাম্রাজ্য বিস্তারের পটভূমি।
কাবুলে বাবরের আগমনের পর ইব্রাহিম লোদীর প্রতি ক্ষিপ্ত পাঞ্জাবের আফগান শাসক দৌলত খাঁ লোদি ও আলম খাঁ লোদী বাবরকে ভারত আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান রাজপুত নেতা রানা সংঙ্গ ও বাবরকে উদ্বুদ্ধ করেন এদের ধারনা ছিল বাবুর তৈমুরের মতো লুট রাজ করে চলে যাবে সাম্রাজ্য স্থাপন করবে না। যা পরবর্তীকালে ভুল প্রমাণিত হলো।
দৌলত খাঁ লোদীর প্রত্যাশামত বাবর ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে ভিরা নগরী আক্রমণ করেন এবং ইব্রাহিম লোদীর কাছে দূত মারফত পূর্বপুরুষ তৈমুরের অধিকৃত অঞ্চল ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু দৌলত খানের যথার্থ সহযোগিতার অভাবে বাবর কাবুল প্রত্যাবর্তন করেন। ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে বাবর সিন্ধু, ঝিলাম, চেনাব অতিক্রম করে পাঞ্জাবের দীপালপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এবার কিন্তু দৌলত খাঁ লোদি বাবরকে বাধা দেন কিন্তু অনায়াসে বাবর পাঞ্জাব দখল করে। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে ছিল এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পরিণতি যেখানে বাবর তার গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে অভিনব তুলঘুমা পদ্ধতির সুবাদে ইব্রাহিম লোদীকে পরাস্ত ও নিহত করে দিল্লি ও আগ্রা দখল করেন পানিপথের প্রথম যুদ্ধে (1526 এপ্রিলে)।
আফগানরা কিন্তু নিশ্চিহ্ন হননি আঞ্চলিক সরদার দের নেতৃত্বে তারা বেশ শক্তিশালী ছিল রানা সংঙ্গ পরিস্থিতি বুঝে আফগানদের সঙ্গে আঁতাত করেন। ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে খানুয়ার যুদ্ধে বাবর স্বয়ং রানা সঙ্গের নেতৃত্বধীন রাজপুত আফগান বাহিনীকে পরাস্ত করেন। ফলে পশ্চিম ভারতে মুঘল আফগান প্রতিদ্বন্দ্বিতা আপাতত শেষ হয়।
এদিকে পূর্ব ভারতে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে আফগান সর্দার রা ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য মাহমুদ লোদীর নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ হয়। বাংলার নসরত শাহ এদের সঙ্গে যোগ দেন। বাবর কূটনৈতিক চাল চেলে নসরত শাহ সহ বেশ কয়েকজন আফগান দলপতি কে নিজেদের পক্ষে টেনে নেন। বাকিদের তিনি ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে ঘর্ঘরার যুদ্ধে পরাস্ত করেন তবে পূর্ব ভারতের আফগানরা এত সহজে ভাঙবার ছিলনা।
মুঘল আফগানদের প্রাথমিক পর্বে মুঘলরা সফল হলেও দ্বিতীয় পর্বে উল্টোটাই ঘটে, ১৫৩০ এর শেষে বাবরের মৃত্যুর পর হুমায়ুনের সময়ে মুঘলদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল আগের তুলনায় শক্তিশালী ও সঙ্ঘবদ্ধ।
কালিঞ্জর এর নরপতিরা আফগানদের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন ছিলেন বলে হুমায়ুন কালিঞ্জার আক্রমণ করেন। পূর্বদিকে আফগানদের অভ্যুত্থানের সংবাদ পেয়ে কালিঞ্জরের নরপতির সঙ্গে একটি রফা করে হুমায়ুন দ্রুত পূর্ব দিকে এগিয়ে গেলেন। মাহমুদ লোদীকে জৌনপুর থেকে তাড়িয়ে দেন। এরপর সেখানে শের খানের চুনার দুর্গ অবরোধ করেন কিন্তু শের খানের মৌখিক বশ্যতা শিকারের প্রতিশ্রুতি পেয়ে তাকে ছেড়ে দেন এটি ছিল তার অন্যতম রাজনৈতিক ভুল।
এবার পশ্চিম ভারতের গুজরাটের বাহাদুর শাহ। যিনি কয়েকজন আফগান অভিজাতকে আশ্রয় দিয়ে হুমায়ুনের বিরাগ ভাজন হয়েছিল। হুমায়ুন আক্রমণ করলে এই অবসরে শের খাঁ শক্তি সঞ্চয় করেন। অবস্থা বুঝে হুমায়ুন বিহার ও বঙ্গদেশের দিকে রওনা হলে পূর্বাধিকৃত গুজরাট হাতছাড়া হয়ে যায়।
হুমায়ুন সোজা বঙ্গ দেশে না গিয়ে চুনার দুর্গ অবরোধে সময় নষ্ট করেন। ফলে যখন তিনি বঙ্গদেশে গেলেন শের খান তার আগেই বঙ্গদেশ ছেড়ে পশ্চিম দিকে এগিয়ে যান এবং কৌনজ থেকে জৌনপুর পর্যন্ত ক্ষমতা বিস্তার করেন এবং ইতিমধ্যেই বঙ্গদেশ থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ রোটাস দুর্গে স্থানান্তরিত করেন।
শের খান যখন গৌড় ত্যাগ করেন তখন হুমায়ুন বর্ষার সৌন্দর্য উপভোগ করতে তিন মাস গৌড়ে কাটিয়ে দেন। এদিকে শের খান হুমায়ুনের দিল্লি ও আগ্রা প্রত্যাবর্তনের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল। এই খবর পাওয়া সত্ত্বেও তিনি বঙ্গদেশ থেকে ফেরার চেষ্টা করেন এবং ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে শের খানের হাতে সম্পূর্ণ পরাজিত হন এভাবে শের খানের নেতৃত্বে আফগান শক্তি পুনরুদ্ধার ঘটে। ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে বিল্বগ্রাম বা কৌনজের যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে পারস্যে পলায়ন করেন।
শের শাহের পরবর্তী বংশধরদের সময়ে আফগান সাম্রাজ্যের অন্তদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এদিকে 15 বছরের নির্বাসিত জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে হুমায়ুন আবার ফিরে আসে। বৈরাম খানের সক্রিয়তা সহযোগিতা ও বন্ধুত্বকে হাতিয়ার করে হুমায়ুন ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে শিরহিন্দের যুদ্ধে সিকান্দার শূর কে পরাস্ত করে দিল্লি ও আগ্রা পুনরুদ্ধার করেন।
পূর্ব ভারতে আফগানদের পরাস্ত করার আগেই হুমায়ুন মারা যান। আদিল শাহের সেনাপতি হিমু, আগ্রার দিকে অগ্রসর হলে নাবালক সম্রাট আকবরকে সামনে রেখে বৈরাম খান ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে আফগানদের পরাস্ত করেন। মুঘল আফগান আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে যদিও আবুল ফজল বলেছেন পূর্ব ভারতের আফগানরা এত সহজে শান্ত হননি। আকবরকে বহু কাল ধরে কূটনীতি ও অস্ত্রের সাহায্যে এদের দমন করতে হয় হয়েছিল।
দীর্ঘকালীন মুঘল আফগান দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত মুঘলদের জয়ের পিছনে ঐতিহাসিকগণ কিছু কারণ এর উল্লেখ করেছেন। আফগানদের উপজাতি ঐতিহ্য, ঐক্যবদ্ধ রাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা ছিল। তাই শেরশাহের পর থেকে অন্তবিরোধ সামনে চলে আসে। ইক্তলাম সাহেব মৃত্যুর পর শূর সাম্রাজ্য পাঁচটি খন্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। তাই সম্পদ বা লোকজনের ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্য আফগানরা সফল হতে পারিনি।
দ্বিতীয়তঃ অধ্যাপক সতিশচন্দ্র হিমুর পরাজয়ের পিছনে আফগান দলপতি দের হিমুকে মেনে না নেবার বা বিরোধিতাকে দায়ী করেন।
তৃতীয়ত আফগানদের তুলনায় মুঘলদের সামরিক কৌশল ছিল উন্নত তুলঘুমা পদ্ধতি, ভালো গোলন্দাজ বাহিনী, দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনী, দক্ষ তিরন্দাজ মুঘলদের কাছে জয় এনে দিয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যুদ্ধক্ষেত্রেই হিমুর চোখে তীর বিদ্ধ হয়েছিল অন্যদিকে হিমুর গোলন্দাজ বাহিনী মুঘলরা দখল করে নিয়েছিল আফগানদের হস্তি বাহিনীর উপর বেশি যোগ দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধে পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন