দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রাথমিক পর্বে অভিজাত শ্রেণীর স্থান ছিল ঠিক সুলতানের পরেই। অভিজাতরা ছিল সুলতানের সবথেকে নির্ভরযোগ্য অবলম্বন।সুলতানি শাসন ব্যবস্থায় অভিজাত সম্প্রদায় উল্লেখযোগ্য ভাবে অংশগ্রহণ করত। অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে তুর্কি উমরা গনই ছিল অধিক সংখ্যক। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের দ্বারা এই অভিজাত শ্রেণী গঠিত ছিল বলে তাদের মধ্যে কোন এক জাতীয় ভাব-ধারা গড়ে ওঠেনি। অভিজাতদের মধ্যে খান খেতাব ধারিরাই ছিল সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। তবে প্রাথমিক পর্বে সুলতান ও অভিজাতরা একই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর ফলস্বরূপ দিল্লি সুলতানি যুগে অভিজাত বনাম রাজতন্ত্রের দীর্ঘদিন সংগ্রাম চলেছিল।
কুতুব উদ্দিন এর মৃত্যুর পর দিল্লির শিশু সুলতানি সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারত। কিন্তু দিল্লির শুভবুদ্ধি সম্পন্ন অভিজাত সম্প্রদায় ইলতুৎমিসকে মনোনীত করে দিকে যেমন দিল্লির শিশু সুলতানি সাম্রাজ্যের ভাগ্য ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেছিলেন অপরদিকে তেমনি নিজেদের মর্যাদার অভাবনীয় রূপে বৃদ্ধি করেছিলেন। ইলতুৎমিস সিংহাসন আরোহন করে অভিজাতদের গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। অভিজাতগণ এই মর্যাদা অটুট রাখার উদ্দেশ্যে চল্লিশ চক্র নামক এক যৌথ সংস্থা গঠন করে শক্তি সঞ্চয় করে।
ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর অভিজাত দের ক্ষমতা এতো বেড়ে যায় যে সুলতানরা তাদের হাতের খেলনা তে পরিণত হয়। ইলতুৎমিস মৃত্যুর আগে কন্যা রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছেন। কিন্তু অভিজাতগণ একজন নারীর শাসনকে এই কাজে উপযুক্ত মনে করেননি। তাই অভিজাতরা রুকুউদ্দিন ফিরোজকে সিংহাসনে বসেন। ফলে রাজিয়ার সময় অভিজাত বনাম রাজতন্ত্রের সংগ্রাম শুরু হয়। এই সংগ্রামে রাজিয়া, প্রথম অভিজাতদের ক্ষমতা ও ঔদ্ধত্যকে খর্ব করে রাজতন্ত্রকে প্রকৃত সর্বভৌম ক্ষমতা দান করার চেষ্টা করেন। এই সংগ্রামে অভিজাতদের কাছে রাজিয়া পরাজিত হন ও প্রাণ দেন।
চল্লিশ চক্রের নেতা বলবন সিংহাসন আরোহন করে উপলব্ধি করেন যে যদি অভিজাতদের মর্যাদা ও ঔদ্ধত্য খর্ব করা না যায় তাহলেই রাষ্ট্রের ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনা হবে । তাই প্রথমেই তিনি এই চল্লিশ চক্রের প্রভাবশালী সদস্যদের হত্যা করেন এবং তারপরে সংস্থাকে ভেঙে দেন। প্রকৃতপক্ষে বলবন রাষ্ট্রের অভিজাতদের অস্তিত্বে রক্ষার বিরোধিতা করতে না তিনি বিরোধী ছিলেন তারা যাতে কোন সংস্থা গঠন করে সুলতানের কাজে হস্তক্ষেপ করতে না পারে।
আলাউদ্দিন খলজির অভিজাতদের মর্যাদা ও ঔদ্ধত্য খর্ব করতে তাদের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা বাতিল করে। এবং তাদের ওপরে কর ধার্য করে । অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ভারতীয় মুসলমানদের ক্ষমতাও মর্যাদা দিয়ে এক নতুন অভিজাত শ্রেণি গড়ে তোলেন। ফিরোজের শাসনকালে দেখা যায় অভিজাতদের শ্রেণী ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফিরোজ শাহ তুঘলকের রাজত্বের পর থেকে অভিজাত্যের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বিবাদের ফলে সুলতানি সাম্রাজ্য কে চরম অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
পরিশেষে বলা যায় অভিজাতরা দুর্বল সুলতানদের শাসনকালে খুব সহজেই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের ভূমিকা গ্রহণ করত। কিন্তু বলবন, আলাউদ্দিন খলজী, মোহাম্মদ বিন তুঘলক প্রভৃতি দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শাসকগণ অভিজাতদের ক্ষমতা ও প্রাধান্য কে রাষ্ট্রের পক্ষে বিপদজনক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে তাদের ক্ষমতা খর্ব করে রাজতন্ত্রকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন