সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাংলায় ইলিয়াস শাহী বংশের অবদান আলোচনা কর।

 সুলতানি যুগ ধরে বঙ্গদেশ প্রায় স্বাধীন বা আধা স্বাধীন রাজ্য বলা চলে। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বক্তিয়ার খলজির দ্বারা বঙ্গদেশ তুর্কি অধিকারে আসলেও পরবর্তী বছরগুলিতে কখনোই দিল্লির সুলতানি শাসন বাংলার উপর সম্পূর্ণ অধিপত্য বিস্তার করতে পারিনি। সাময়িকভাবে বাংলার শাসকগণ দিল্লির অধীনতা স্বীকার করত, আবার দিল্লির আক্রমণের গরম কেটে গেলেই বিদ্রোহ করতো। সুতরাং আর যাই হোক বাংলাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল সুলতানি যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মোহাম্মদ বিন তুঘলক এর রাজত্বকালের শেষ দিকে অরাজকতা ও বিদ্রোহের সুযোগে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বাংলায় স্বাধীন ইলিয়াস শাহী শাসনের প্রতিষ্ঠা করেন ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে। এই রাজবংশের আরো দুজন শ্রেষ্ঠ শাসক হলেন সিকান্দার শাহ ও গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ। যদিও পরবর্তী ইলিয়াসাহি শাসকদের হটিয়ে দিনাজ পুরের রাজা গণেশ ও তার পুত্ররা কিছুকালের জন্য শাসন করেছিল কিন্তু ইলিয়াস শাহ এর বংশধরেরা ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেছিলেন। 

আলাউদ্দিন আলিশাহ কে সিংহাসন চুত্য করে ইলিয়াস শাহ ক্ষমতায় আসেন তিনি বঙ্গদেশের রাজনৈতিক সংহতি স্থাপন করেন এবং বাংলার বাইরে ও বিজয়াভিযানকে সম্প্রসারিত করেন। তিনি ত্রিহূত জয় করেন। নেপালে প্রবেশ করে কাঠমান্ডু থেকে প্রচুর ধনরত্ন লাভ করেন। উড়িষ্যা আক্রমণ করে মন্দিরগুলি লুট করে। সোনার গায়ের ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহকে পরাস্ত করেন। ফিরোজ শাহ তুঘলকের সঙ্গে লড়াইয়ের পর বিহারের কুশী নদী পর্যন্ত বাংলার সীমানা নির্ধারণ করেন। তিনি কামরূপ ও ত্রিপুরা রাজ্য আক্রমণ করে এবং সম্ভবত কামরূপের কিছু অংশ জয় করেছিলেন এইভাবে বঙ্গদেশে এক রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। 


ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র সিকান্দার শাহ বাংলার সীমানা ও কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। ফিরোজ শাহ তুঘলক দ্বিতীয়বার বাংলা আক্রমণ করলে তিনি পিতার মতো একডালা দুর্গে আশ্রয় নিয়ে আত্মরক্ষা করেন এবং দিল্লির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপিত করেন। গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের সময় অহম বংশীয় কামতার হিন্দু রাজ্য অভিযান করে। আরাকান রাজ সিংহাসনচুত হয়ে গিয়াস উদ্দিন কাছে আশ্রয় নেন। চীনের সাথে দূত বিনিময়ে ঘটে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়। গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের পরবর্তী শাসকগণ হলেন যথাক্রমে সইফুদ্দিন হামজা শাহ, শিহাব উদ্দিন বায়াজিদ শাহ এদের রাজনৈতিক অবদান বিশেষ কিছু জানা যায় না ।


ইলিয়াস শাহী শাসকদের হটিয়ে দীনাজপুরের রাজা গণেশ এবং তার পুত্ররা বাংলা শাসন করেন। নাসির উদ্দিন মোহাম্মদ শাহ পুনরায় ইলিয়াস শাহী বংশের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। 


ইলিয়াস শাহী শাসকগণ বঙ্গদেশে উদার ধর্মনিরপেক্ষ শাসন গড়ে তোলেন। ব্যক্তিত্বের জোরে ওরা হিন্দুদের ব্যাপক সহযোগিতা লাভ করেছিল। ইলিয়াস শাহের সেনাদলে হিন্দু পাইকদের নাম ছিল। তারিখ-ই-মোবারক শাহ থেকে জানা যায় তার সেনাপতি সহদেবের কথা, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে পড়া ন্যায় পরায়ন বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলেন। 


চীনা দূতদের বিবরণ ও ইবন বতুতা সাক্ষ্য থেকে সমকালীন বাংলার আত্মসামাজিক অবস্থার কথা জানা যায়। বাংলায় প্রচুর কৃষিজ ও শিল্প পণ্য উৎপাদন হতো। রেশমের চাষ ছিল, উৎকৃষ্ট বস্ত্র তৈরি হতো। সারা বছর ধরে চাষ হতো ধান, গম, সরিষা, ডাল, নারকেল, পেঁয়াজ, রসুন, পান, ফলের মধ্যে কাঁঠাল, কলা প্রভৃতি চাষ হতো। পশু পালনের কথাও জানা যায়। মোটা ও সুক্ষ দুই ধরনের সুতিবস্ত্র উৎপাদন হতো। গাছের ছাল থেকে কাগজ তৈরি হতো। 


সামাজিক ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল তবে তারা একসাথে বাস করত। সম্প্রদায়িক সমস্যা ছিল না। দরবেশদের প্রভাবে অনেক লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। হিন্দু মুসলিম সকলে বাংলা ভাষায় কথা বলতো। তবে ফরাসি ভাষার প্রচলন ছিল অফিসে। সমাজে জ্যোতিষী, চিকিৎসক প্রভুতি গোষ্ঠীর কথা জানা যায়। 


চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিদেশের সাথে বাণিজ্য চলত। সাতগাঁও ও শ্রীপুর ছিল অন্যতম বন্দর। সোনা ও রুপার টাকা এবং কড়ির প্রচলন ছিল। জীবনযাত্রার ব্যয় ছিল খুব কম। বাংলাদেশে প্রাচুর্য ছিল তা নিয়ে আর কোন সন্দেহ নেই। 


ইলিয়াস শাহের শাসনকাল বঙ্গদেশের সাহিত্য ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে নবযুগের সূচনা করে। প্রথম তিন শাসক ছিলেন সুপণ্ডিত। গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ তার কবিতার লাইনপূর্ণ করতে ইরানের কবি হাফিজের কাছে কবিতাটি পাঠান। তাদের সময় বাংলা ভাষা তার শৈশব পার করে। চর্যাপদ থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের উত্তীর্ণ হয়। গজল সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি হয় পরবর্তী শাসক রুকউদ্দিন বরবাক শাহ পাণ্ডিত্যের নিদর্শন স্বরূপ অলকামিল ও অলফাজিল উপাধি দুটি ধারণ করেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় বৃহস্পতি মিশ্র গীতগোবিন্দ, কুমারসম্ভব, রঘুবংশম প্রভীত প্রভৃতি গ্রন্থের টীকা লেখেন। বিশারদ নামে এক জ্যোতিষী বারবাক শাহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। মালাধর বসু শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য লিখে তার কাছ থেকে গুনরাজ খান উপাধি পান। বাংলা ভাষায় প্রথম রামায়ণ রচয়িতা কবি কৃত্তিবাস ওঝা তার কাছে সম্মানিত হন। 


 ইলিয়াস শাহী শাসকগণ রাজধানী পান্ডুয়াকে ও গৌড়কে চমৎকার অট্টালিকায় শোভিত করেন। তাদের তৈরি মসজিদ ও সমাধি ভবনগুলি শিল্প রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইলিয়াস শাহ প্রতিষ্ঠা করেন হাজিপুর শহর। একডালা দুর্গ বিস্ময়কর নির্মাণ যা আজ আর নেই। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সিকান্দার শাহের তৈরি পান্ডুয়ায় আদিনা মসজিদ। দামাস্কাসের মসজিদের অনুকরণে এটি তৈরি। পার্সী ব্রাউন এর ভুয়োসী প্রশংসা করেছেন। এছাড়া আখ-ই-সিরাজ মসজিদ ও কোতোয়াল ই দরজা ইলিয়াস শাহীদের অন্যতম সৃষ্টি। শিক্ষার ক্ষেত্রে ওরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন ওরা মাদ্রাসা তৈরি করেন। ইউসুফ শাহ একটি কলেজ তৈরি করেন। 


রাজনৈতিক স্বাধীনতা থেকে শুরু করে আর্থিক সমৃদ্ধি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণে সাহিত্য ও শিল্পের বিকাশের সূচনা ইলিয়াস শাহীদের অবদান যে পটভূমির উপর হুসেন সাঈদীর বাংলার গৌরব কে চরম শিখরে পৌঁছে দেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...