মাহমুদ গাওয়ান ছিলেন দাক্ষিণাত্যের শাসকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ প্রশাসক। তিনি ছিলেন মধ্যযুগের অন্যতম তীক্ষ্ণবুদ্ধির সম্পন্ন দূরদর্শী রাজনৈতিক। তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন ইরানের এক গ্রামের অধিবাসী। ৪৫ বছর বয়সে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে দাক্ষিণাত্যে আসেন এবং সুলতান দ্বিতীয় আলাউদ্দিন এই পরদেশীর গুনে আকৃষ্ট হয়ে তাকে রাজসভায় আমির পদে অভিষিক্ত করেন। সুলতান হুমায়ুন গাওয়ানকে Malik-ut-Tajjar উপাধিতে ভূষিত করেন।
খাজা মাহমুদ গাওয়ান বাহমনি রাজ্যের তিনজন সুলতানের অধীনে কাজ করেন এবং তৃতীয় মুহাম্মদ এর রাজত্বকালে তিনি রাজ্যের প্রকৃত শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি শাসনকার্যে ও সমর ক্ষেত্রে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়ে প্রজাদের প্রীতি ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। তিনি ক্ষমতার চরম শিখরে আরোহন করেছিলেন কিন্তু কখনো ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি।
১৪৬১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান হুমায়ূনের মৃত্যু হলে তার পুত্র নিজাম শাহ মাত্র ৮ বছর বয়সের সিংহাসন আরোহন করেন। এই নিজাম শাহের অভিভাবক নিযুক্ত হয়েছিলেন মাহমুদ গাওয়ান। যখন অভিভাবক নিযুক্ত হয়েছিলেন তখন বাহমনী রাজ্যের অবস্থা ছিল অত্যন্ত করুন। রুশ ভ্রমণকারী নিকীতিন ১৪৬৯ থেকে ১৪৭৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যে খাজা ইউসুফ খোরাসানী এই ছদ্নামনামে পরিভ্রমণ করেছিলেন। তিনি তার বিবরণে বাহমনি রাজ্যের করুণ দশার বিবরণ দিয়েছেন।
১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে নিজাম শাহের মৃত্যুর পর তার নাবালক ভ্রাতা তৃতীয় মোহাম্মদ সিংহাসন আরোহন করেন। রাজমাতা মখদুমা রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। রাজমাতা প্ররোচনায় খাজা জাহান নিহত হলে মাহমুদ গাওয়ানকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন। তিনি যখন ক্ষমতা লাভ করেন তখন বাহমনী রাজ্যের চরম সংকট উপস্থিত হয়েছিল। সেই সময়ে রাজসভায় অভিজাতরা পরদেশী ও দক্ষিণী দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে অভিজাতদের মধ্যে এক চরম বিদ্বেষ পুণ্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মাহমুদ গাওয়ান তার সূক্ষ্ম বিচার বুদ্ধি ও কৌশলে সকলের প্রতি সমব্যবহার নীতি গ্রহণ করে বাহমনি রাজ্যের একজন চরম শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
মাহমুদ গাওয়ান বাহমনি রাজ্যের এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। নাবালক সুলতানের সুযোগ নিয়ে উড়িষ্যার রাজা কপিলেন্দ্র, তেলেঙ্গানা রাজার সাহায্যে বাহমনি আক্রমণ করেন কিন্তু গাওয়ান সেই আক্রমণ প্রতিহত করেন। এই সুযোগে মালবের সুলতান মাহমুদ খলজি বাহমনী রাজ্য আক্রমণ করেন ও রাজধানী বিদর দখল করেন। মাহমুদ গাওয়ান সঙ্গে সঙ্গে গুজরাটের সুলতানের সাহায্যে তাকে বিতাড়িত করেন। তিনি বিজয়নগর ও ওড়িশার বিরুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে কঙ্কোনের রাজগণকে পরাজিত করে কঙ্কোন থেকে গাওয়ান বহু ধনসম্পদ লাভ করেন। এরপর গাওয়ান কাঞ্চির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং প্রচুর ধনসম্পদ লাভ করেন। এইভাবে তিনি বাহমনি সাম্রাজ্যের সীমা উত্তরে খান্দেশ, দক্ষিণে তুঙ্গাভদ্রা, উত্তর পূর্বে উড়িষ্যা ও দক্ষিণ পশ্চিমে গোয়া শহর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছিল।
শুধু বাহমনি রাজ্যের বিস্তার করেই তিনি ক্ষান্ত ছিলেন না। বাহমনি রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় সংহতি আনার জন্য সর্ব বিভাগের শাসন সংস্কারে মনোযোগী হন। তিনি বাহমনি রাজ্যের অর্থ বিভাগ, বিচার বিভাগ, সামরিক বিভাগ, জনশিক্ষা বিভাগ, রাজস্ব বিভাগের সংস্কার সাধন করে রাজ্যের শাসন ব্যবস্থাকে একটি সুদৃঢ় ভৃত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন। যারা দোষী বিবেচিত হতো তাদেরকে কঠিন শাস্তি প্রদান করা হতো।
কেন্দ্রীয় শক্তিকে দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে বাহমনি রাজ্যে যে চারটি বিভাগ বা তরফ ছিল গাওয়ান তার প্রতিটি তরফকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেন। এবং তরফদারদের ক্ষমতা সংকুচিত করেন। প্রাদেশিক শাসকদের ক্ষমতা সংকুচিত করায় গাওয়ানের উপর তরফদাররা বিশেষভাবে রুষ্ট হয় এবং দক্ষিণীদের নেতা হাসান তরফদারদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গাওয়ানের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন এবং গাওয়ানকে উৎখাত করার চেষ্টা করেন।
চরম আনুগত্যের সঙ্গে তিনি সামরিক বিভাগের সংস্কার সাধনে করে তিনি তার সমস্ত নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সুলতানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল অভিজাতদের ক্ষমতা দুর্বল করে কেন্দ্রীয় শক্তিকে শক্তিশালী করে তোলা। এতদিন ধরে রাজ্যে দক্ষিণী ও পরদেশী অভিজাতদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলছিল তা চরম আকার ধারণ করে। কিন্তু গাওয়ান কোন দলে যোগ না দিয়ে সুলতানের চরম বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। তিনি সেনা বিভাগীয় চরম শৃঙ্খলা আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। ন্যায় বিচারক রূপে ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এগুলি তার শাসনতান্ত্রিক প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে।
তিনি সত্যতা ও আনুগত্যের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের উন্নতি সাধনে ব্রতী হন। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তিনি অদম্য শিক্ষা অনুরাগী ছিলেন। বিদরে তার নিজস্ব পুস্তকালে তিন সহস্রাধিক পুস্তক ছিল। তিনি অংকশাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা ও সাহিত্যে তার অনুরাগ ছিল। বিদরে তিনি একটি মহাবিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
বহু গুণের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও গাওয়ান শুধুমাত্র পরদেশী এই অপরাধে দক্ষিণ দলের নেতা হাসান তার প্রতিপত্তিতে ঈর্ষান্বিত হন। গাওয়ানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তৃতীয় মোহাম্মদ এর মনকে গাওয়ানের প্রতি বিদিষ্ট করে তোলেন এবং ষড়যন্ত্র করে মিথ্যা জাল চিঠি সুলতানের নিকট পৌঁছে দেন। ১৪৮১ খ্রিস্টাব্দে সুলতান এই মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে মাহমুদ গাওয়ানকে প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন। যদিও সুলতান তৃতীয় মোহাম্মদ শাহ তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছিলেন এবং দুঃখিত ও অনুতপ্ত হৃদয়ে এক বছর পর তার মৃত্যু ঘটে। ঐতিহাসিকরা একমত যে মাহমুদ গাওয়ানের মত একজন বিচক্ষণ শাসকের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে বাহমনী রাজ্যের শেষ চিহ্নটুকু বিলুপ্ত হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন