আলাউদ্দিন খলজির শাসনব্যবস্থায় অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার অর্থনৈতিক সংস্কার সমূহ। আলাউদ্দিনই দিল্লির সার্বভৌম সুলতানদের মধ্যে প্রথম যিনি একই সাথে সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ এবং মঙ্গল আক্রমণ এবং ও অভ্যন্তরীণ বিরোধের মোকাবেলা চালিয়ে দেশে শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপনের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেন। স্বভাবত এজন্য এক বিশাল সেনাবাহিনী পোষণ করতে হয়েছিল। যাদের ব্যয়বহুদ ব্যয় বাবদ প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল বলা হয় এজন্যই আলাউদ্দিন অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজে হাত লাগান। তার প্রধান দুটি পদক্ষেপ ছিল রাজস্ব সংস্কার ও বাজারদর নিয়ন্ত্রণ।
আলাউদ্দিনই হলো প্রথম সুলতান যিনি রাজস্ব সংস্কারের কাজে হাত দেন। তার রাজস্ব সংস্কারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সমকালীন ও পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়েছে। এটা ঠিক তার মূল উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে রাজকোষ পূর্ণ করা। এর সাথে একটি রাজনৈতিক স্বার্থও ছিল অভিজাত, জমিদার, খুৎ মুকাদ্দাম দের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙে দিয়ে আলাউদ্দিন বিদ্রোহের সম্ভাবনা নির্মূল করতে চেয়েছিলেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল হিন্দু তাই হিন্দুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বারনি বলেছেন হিন্দুদের প্রতি তার কঠোর নীতি প্রযুক্ত হয়েছিল। তাই হিন্দু বিদ্বেষী অভিযোগও তার বিরুদ্ধে ঘটে। ইরফান হাবিব দেখিয়েছেন খুৎ, মুকাদ্দাম, চৌধুরীরা প্রজাদের উপর বাড়তি কর আদায় করে অথচ সরকারকে না দিয়ে আমোদ প্রমোদ ব্যায় করে। বারনি স্বীকার করেছে যে আলাউদ্দিনের ব্যবস্থার ফলে স্থানীয় প্রজাদের বাড়তি কর কিসমত- ই-খ্যেতি আদায় বন্ধ হয়ে যায়। কৃষকদের উপর অত্যাচার বন্ধ হয়। তাছাড়া জমিদার শ্রেণী ছিল মূলত হিন্দু। মুসলমান অভিযাতরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কিন্তু তাদের সংখ্যা অত্যন্ত কম হওয়ায় বারনির চোখে তা পড়েনি। ডঃ নিজামি বলেছেন আলাউদ্দিন জমিদারদের স্বায়ত্ত শাসনে হাত দেন নি। অবশ্য ডঃ লাল বলেছেন আলাউদ্দিনের উদ্দেশ্য ছিল রাজস্ব ব্যবস্থা সুসংহত করা।
আলাউদ্দিনের আগে জমির রাজস্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে চার শ্রেণীতে বিভক্ত জমি ছিল। খালিশা অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন জমি, ইকতাদারদের অধীনের জমি, যাদের অধীনে চৌধুরী, মুকাদ্দাম, খুৎ প্রভৃতি রাজস্ব আদায় করতেন। তৃতীয়তও হিন্দু জমিদারদের শর্তসাপেক্ষ জমির রাজস্ব আদায়ের ভার দেওয়া হয়েছিল। চতুর্থ বিদ্বান ও সাধুসন্তদের দান করা জমি বা ইনাম অথবা ওয়াকত জায়গির। এই ব্যবস্থায় মধ্যসত্ত্বভোগীদের বাড়তি আদায়ের সম্ভাবনা ছিল। দান জমিগুলির জায়গীর প্রায় বংশানুক্রমিক হয়ে যায়। খুৎ, চৌধুরী প্রভৃতি কর্মচারীগণ চাষীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতো কিন্তু সরকারকে ফাঁকি দিয়ে বিলাস বাসন করতো।
আলাউদ্দিন রাজস্ব ব্যবস্থায় বিপুল পরিবর্তন আনলেন দান জমিগুলির জায়গীর বাতিল করে সব জমি কে প্রথম খালিসার অন্তর্ভুক্ত করে। বারনির বিবরণ থেকে জানা যায় সুলতান খরাজ (ভূমিকর) চড়াই (চারণ কর) খড়ি (গৃহকর) কৃষকদের উপর স্থাপন করেন। জমির উৎপন্ন ফসলের ৫০% রাজস্ব ধার্য করেন জমি জরিপের ব্যবস্থা করা হয়। নগদ রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা হয়। তবে খালিশার অন্তর্গত দোয়াবের কিছু অঞ্চল থেকে শষ্যে রাজস্ব আদায় হতো। হিন্দুদের উপর জিজিয়া ও মুসলমানদের উপর যাকাত ধার্য করেন। খু্ৎ, চৌধুরী, প্রভৃতি গ্রাম প্রধানদেরও নিজে নিজে জমির ক্ষেত্র ক্ষেত্রে সমান অনুপাতে রাজস্ব ধার্য হয়। রাজস্ব ব্যবস্থাকে সফল করার জন্য দক্ষ ও সৎ কর্মচারী নিয়োগ করেন। এবং কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
আলাউদ্দিনের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার মূল নীতি ছিল কৃষকদের অত্যাচার করে স্থানীয় প্রধানরা যাতে ধনী হয়ে উঠতে না পারে। সতীশ চন্দ্র বলেছেন আলাউদ্দিনের রাজস্ব ব্যবস্থা কেবল হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয় সুবিধাভোগী শ্রেণীর বিরুদ্ধে। জিয়াউদ্দিন বারনীর বিবরণ থেকে জানা যায় নতুন ব্যবস্থায় সুবিধাভোগীরা সাধারণ কৃষকের সমতুল্য হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত করভার, নগদ রাজস্ব আদাই এর ফলে কৃষকদের অবস্থার অবনতির সম্ভাবনা ছিল কিন্তু পণ্য মূল্য বেঁধে দেওয়ায় এবং মধ্যস্বত্তভোগীদের শোষণ বন্ধ হওয়ায় কৃষকরা তেমন অসুবিধায় পারেনি। আলাউদ্দিনের সময় কোন কৃষক বিদ্রোহ হয়নি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন