সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজনৈতিক পরীক্ষা নিরীক্ষা

মুহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজনৈতিক পরীক্ষা নিরীক্ষা

গিয়াস উদ্দিনের মৃত্যু পর তার য্যেষ্ঠ পুত্র জৌনাখান মোহাম্মদ বিন তুঘলক নাম ধারণ করে ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সিংহাসন আরোহন করেন। পিতার মতো মোহাম্মদ বিন তুঘলকও সৈনিক হিসেবে জীবন আরম্ভ করেছিলেন এবং সৈনিক হিসেবে অল্প বয়সেই যথেষ্ট কির্তৃত্বের পরিচয় দেন। বলা হয় মোহাম্মদ বিন তুঘলক এর সাহায্য ছাড়া গিয়াস উদ্দিনের সিংহাসন দখল এত মসৃণ হতো না

মধ্যযুগের নরপতিদের মধ্যে মোহাম্মদ বিন তুঘলক যে সবচেয়ে সুদক্ষ ও মৌলিক চিন্তার অধিকারী ছিলেন সে কথা ঈসামি, ইবন বতুতা, জিয়াউদ্দিন বারনী মত সমকালীন মৌলবাদী লেখক ও স্বীকার করে নিয়েছে। তাদের মতে তর্কবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, অংকশাস্ত্র, বিজ্ঞান, দর্শনে তার অসাধারণ জ্ঞান ছিল। পারসিক বিখ্যাত কবিতা সমূহ তার কণ্ঠস্থ ছিল। এমনকি চিকিৎসা বিদ্যাও তার অজানা ছিল না। 

মোহাম্মদ বিন তুঘলকের রাজনৈতিক ধ্যানধারণা বিচার করতে গেলে আমাদের তার ধর্মনৈতিক ধ্যান-ধারণাকে বিচার করতে হবে। মধ্যযুগের ধর্মীয় পরিমণ্ডলে মোহাম্মদ বিন তুঘলকের ধর্মনৈতিক ধ্যানধারণা আমাদের পরবর্তীকালে মহান মুঘল সম্রাট আকবরের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন কিন্তু তার মধ্যে কোন ধর্মীয় গোড়ামী ছিলনা।তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমালোচনা মূলক অথচ সংস্কার মুক্ত। হিন্দুদের প্রতি তিনি সদয় ব্যবহার করতেন। সতীদাহ বন্ধ করার মতো সৎ সাহস তিনি দেখিয়েছিলেন। তিনি যোগী এবং রাজশেখর ও জিন-প্রভা সুরি প্রমুখ জৈন সাধুদের সাথে আলোচনা করতেন ।হিন্দু উৎসব ও যোগদান করতেন। হোলি উৎসবেও যোগদান করতেন এমনকি তার সময়ে দাক্ষিণাত্য যুদ্ধে কল্যাণের মন্দির ধ্বংস হলেও তিনি পুনরায় নির্মাণ করে দেন। তার দরবারে বহু হিন্দুকে দায়িত্বশীল পদে বসাতে তিনি দ্বিধা করেননি। এইজন্যেই গোঁড়া মৌলবাদী লেখক ঈসামি, এবং ইবন বতুতা এবং জিয়াউদ্দিন বারনির মত লেখকরা মোহাম্মদ বিন তুঘলকের এই মানসিকতাকে সহ্য করতে পারিনি বলেই সমালোচনা করেছেন। এমনকি ইসামি সুলতান কে বিধর্মী বলতে ও দ্বিধাবোধ করেনি।প্রকৃতপক্ষে মোহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার প্রকৃতির।

মোহাম্মদ বিন তুঘলক বহু গুণের অধিকারী হওয়া সত্বেও ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত এক সুলতান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তার ব্যক্তিগত জীবন ও রাষ্ট্রনৈতিক জীবন সম্পর্কে সমকালীন ঐতিহাসিকরা পরস্পর বিরোধী ধারণা দিয়েছেন। যার ফলে তিনি সত্যকার কি ছিলেন? এক অসামান্য প্রতিভাশালী অথবা উন্মাদ, আদর্শবাদী অথবা কল্পনাবিলাসী, রক্ত পিপাসু স্বৈরাচারী অথবা প্রজাহিতৈষী, ধর্মত্মা অথবা বিধর্মী, এইসব বক্তব্য নিয়ে আধুনিক ভারতের ও বিদেশের ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্কের শেষ নেই। কোন কোন ঐতিহাসিক বারণীর মন্তব্য কে সমর্থন করে সুলতান কে নিষ্ঠুর ও রক্তপিপাসু বলে অভিহিত করেছেন আবার কোন কোন ঐতিহাসিক ইবন বতুতার মন্তব্য কে সমর্থন করে সুলতান কে বিনয়ী সত্যনিষ্ঠা ও উদার প্রকৃতির বলে বর্ণনা করেছেন। তবে বলা যায় তিনি নিজে চিন্তার দিক থেকে যতটা তার যুগ ধর্মকে অতিক্রম করতেও পেরেছিলেন তার সমসাময়িকগণ ততটাই পিছিয়ে ছিলেন। শাসক ও শাসিতের মধ্যে মানসিকতার এই আকাশ পাতাল পার্থক্যকেই তারা ২৬ বছরের রাজত্বকালের ব্যর্থতার এক চরম নিদর্শন বলেও অনেক ঐতিহাসিকগণ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। 


মোহাম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন দিল্লি সুলতানি যুগের শ্রেষ্ঠ উপহার। তিনি ছিলেন উদার ধর্মনিরপেক্ষ ও দুর্ধর্ষ এক পন্ডিত শাসক সিংহাসন আরোহন করেন। সিংহাসনে আরোহন করেই তিনি বেশ কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ শাসনতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। সেগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো দোয়াব অঞ্চলের রাজস্ব বৃদ্ধি,(১৩২৫-১৩২৭) দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তর(১৩২৬-১৩২৭) তামার নিদর্শন মুদ্রা প্রচলন(১৩২৯-১৩৩০)।

দোয়াবের রাজস্ব বৃদ্ধি তার শাসনতান্ত্রিক গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক পর্বের সংস্কার। দোয়াব অঞ্চলে রাজস্ব বৃদ্ধি করে সরকারের আয় বৃদ্ধি করা। প্রকৃতপক্ষে রাজস্ব ব্যবস্থাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করা তার মূল উদ্দেশ্য ছিল। সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখার জন্য প্রাদেশিক সরকার গুলিকে তিনি নির্দেশ দেন। ভূমিকর বৃদ্ধি করার পরিবর্তে অন্যান্য কর শতকরা ৫ থেকে ১০গুণ বৃদ্ধি করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। সর্বত্র একই হারে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করা হতো। সমসাময়িক লেখক জিয়াউদ্দিন বারনি যিনি দোয়াব এ রাজস্ব বৃদ্ধির বিবরণ দিয়েছেন তিনি বলেছেন এই সময় দোয়াব এর দুর্ভিক্ষ চলছিল তবুও সুলতান এই অঞ্চলে তার নতুন নিয়োগ নীতি প্রয়োগ করতে দ্বিধা করেনি। এখানে সুলতান এর কর্মচারীগণের জোর করে রাজস্ব আদায়ের ফলে জনসাধারণের সর্বনাশ ও দুর্গতি দেখা যায়। খাদ্যের অভাবে হাজার হাজার লোক মারা যায়। যারা পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল তাদের সুলতানি সেনাদল বিভিন্ন স্থানে পশুর মতো হত্যা করে। জিয়াউদ্দিন বারনির এই মন্তব্য অতিরঞ্জিত বলেই মনে করা হয়। ঈশ্বরী প্রসাদ মনে করেন বারনির নিজের মাতৃভূমি এই দোয়াব অঞ্চলে অবস্থিত থাকায় তিনি ব্যক্তিগতভাবে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তাই তিনি সুলতানের কঠোর মন্তব্য করেছেন। 

সুলতানের উদ্দেশ্য যাইহোক রাজস্ব বৃদ্ধির ফলে বা দুর্ভিক্ষের জন্য এ অঞ্চলে জনসাধারণের দুর্দশা সৃষ্টি হয়েছিল তা বলার অপেক্ষায় রাখে না। তবে দোয়াবয অঞ্চলে এই দুর্ভিক্ষের মোকাবিলার জন্য সুলতান এক নতুন কৃষি নীতি গ্রহণ করেন। তিনি দিওয়ান- ই -আমির কোহি নামে একটি কৃষি বিভাগ গঠন করেন এবং প্রায় ৭০ লক্ষ তঙ্কা কৃষির উন্নয়নের জন্য ব্যয় করেন। প্রচুর কৃষি ঋণ প্রদান করেন। কুপ খনন করেন, শেচ ব্যবস্থার উন্নতি করেন যা বারনি ও ইসামির বিবরণে সমর্থন পাওয়া যায়। 

মোহাম্মদ বিন তুঘলকের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরীক্ষা ছিল দিল্লি থেকে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর। এটাও ছিল সে যুগে তার এক দুঃসাহসিক অভিনব পরিকল্পনা। রাজধানী স্থানান্তরকেও সমসাময়িক ও পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকরা সমালোচনা করেছেন এবং উদ্ভট পরিকল্পনা বলে মনে করেছেন। তবে দিল্লি থেকে রাজধানী স্থানান্তর সে যুগের গুরুত্বপূর্ণ কারণ। সুলতানের রাজধানী স্থানান্তর বা দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন কখনো রাজনৈতিক অদূরদর্শী বা রাজনৈতিক বিচক্ষণের অভাব এ কথা বলা যায় না।

বারনি বলেছেন দিল্লি থেকে দেবগিরি রাজধানী দেবগিরিতে স্থানান্তরিত করেন এবং দেবগিরির নতুন নাম হয় দৌলতাবাদ। দৌলতাবাদ দেশের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ছিল। দিল্লি, গুজরাট, সোনারগাঁও, তেলেঙ্গানা, দ্বার সমুদ্র, দৌলতাবাদ থেকে সমুদ্ররত্বে তে অবস্থিত ছিল। মোহাম্মদ বিন তুঘলক হঠাৎ করেই রাজধানীর স্থানান্তর করেন। দিল্লি সম্পূর্ণ ধ্বংস করেন। কোন বাড়িতে একটা বিড়াল, কুকুরও ছিল না। দিল্লির সকলকেই জোর করে দিল্লি ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। 

 ইবন বতুতার মতে দিল্লির নাগরিকরা রাত্রিতে মোহাম্মদ বিন তুঘলকের নামে নানা কুৎসা ও কলঙ্কলেপন করে তার রাজদরবারে ছুড়ে ফেলে দিত। সুলতান প্রতিশোধ নেবার জন্য দিল্লি বাসীদেরকে দিল্লি ছেড়ে দৌলতাবাদ যেতে আদেশ দেন। সকলেই দিল্লী ছাড়তে বাধ্য হয়। দিল্লি মরুভূমিতে পরিণত হয় । ইসলামীও তার ৯০ বছরের বৃদ্ধ ঠাকুর দাদাকে কিভাবে জোর করে দৌলতাবাদী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার বিবরণ দিয়েছে। ইসামির ঠাকুর দাদা দৌলতাবাদ পৌঁছাতে পারিনি। দৌলতাবাদের পথেই তার মৃত্যু হয়। তবে এইসব বিবরণ বিশ্লেষণ করলে অতিরঞ্জিতই মনে হয়। অধ্যাপক সতীচন্দ্র মনে করেন তিনি দিল্লির সকল বাসিন্দা কে দৌলতাবাদ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি। সুলতানের অনুপস্থিতিতেও দিল্লি পূর্বের মতো জনবহুল নগরী ছিল। কিন্তু দিল্লি থেকে দৌলতাবাদের দূরত্ব দেড়হাজার কিমি। তারপর সে সময়টার ছিল গ্রীষ্মকাল জনসাধারণের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তীব্র তাপে কষ্ট হয়। যারা শেষ পর্যন্ত দৌলতাবাদে পৌঁছায় তারা দিল্লি ফেরার জন্য কাতর হয়ে ওঠে কারণ দিল্লি ছিল তাদের জন্মভূমি। তাই স্বাভাবিকভাবে জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। কয়েক বছর পর সুলতান আবার দিল্লি প্রত্যাবর্তন করে। কারণ তিনি উপলব্ধি করেন দিল্লি থেকে দাক্ষিণাত্য শাসন করা যেমন অসম্ভব তেমনি দৌলতাবাদ থেকে উত্তর ভারত শাসন করা সহজসাধ্য নয়। তাছাড়া সুলতানের রাজধানী স্থানান্তর নিয়ে এই ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলে রাজকোষে অপরনীয় ক্ষতি হয়েছিল। এবং দিল্লীতার পূর্ব গৌরব হারিয়েছিল।। 

মোহাম্মদ বিন তুঘলকের সর্বপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল ১৩২৯ - ৩০ খ্রিস্টাব্দে রূপাও সোনার পরিবর্তে তামার নিদর্শন মুদ্রা চালু করা। সিংহাসনে আরোহন করেই বাজার দর অনুযায়ী নির্দিষ্ট ওজনের সোনা ও রুপার মুদ্রা প্রচলন করেন। এদের নাম দেন দিনার ও আদালি। খ্রিস্টীয় চৌদ্দ শতাব্দীতে পৃথিবীতে পৃথিবীতে রূপার ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। সম্ভবত তিনি এ বিষয়ে চীন ও পারস্যের কাগজি নোটের প্রচলন থেকে ধারণা লাভ করেছিলেন। তবে মোহাম্মদ বিন তুঘলক রুপার‌ তঙ্কার পরিবর্তে সমমূল্যের ব্রোঞ্চ মুদ্রা প্রচলন করেন। মোহাম্মদ বিন তুঘলকের এই মুদ্রা বিভিন্ন মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। নিদর্শন মুদ্রা প্রবর্তন ভারতবর্ষে মোহাম্মদ বিন তুঘলকের এক অভিনব পরিকল্পনা। 

সমস্যাময়িক ঐতিহাসিক বারনি বলেছেন সুলতানের দ্বারা রাজকোষ পূর্ণ করতে এবং এই অর্থের দ্বারা তার বিশ্ব বিজয়ের পরিকল্পনা সফল করতে চেয়েছিলেন। আধুনিক অনেক ঐতিহাসিক বারনির বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। আবার অনেক ঐতিহাসিক এই বক্তব্যকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন। ঐতিহাসিক গার্ডনার ব্রাউন মনে করেন রাজকোষ পূর্ণ করার জন্য নয় বিশ্বে তখন রুপার সংকট চলছিল বলে তিনি ব্রোঞ্জ মুদ্রা প্রচলন করেন। এমনকি ভারতে রুপার সরবরাহ কম ছিল। মোহাম্মদের সময় রুপার মুদ্রায় রুপার ভাগ কম ছিল রুপার ঘাটতি মেটাবার জন্যই ব্রোঞ্জের মুদ্রার পরিচালন করেন। 

ঐতিহাসিকদের মধ্যে মুদ্রা নীতির উদ্দেশ্য ও সুফল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে এই মুদ্রানীতি আপত্তিকর ছিল না, বরং সাফল্য লাভ করলে মোহাম্মদ বিন তুঘলক ভারতবর্ষের ইতিহাসে একজন আধুনিক অর্থনীতিকের মত দুর্লভ সম্মান পেতে পারতেন। জনসাধারণ এই মুদ্রা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন কারণ এই ব্রোঞ্জের জাল মুদ্রা পুরো সাম্রাজ্যে ছেয়ে যায়। সুলতান যদি জাল মুদ্রা রোধ করতে পারতেন তাহলে তার পরিকল্পনা সফল হতে পারত। জাল নোটের ফলে এই নতুন মুদ্রার মূল্য একেবারে হ্রাস পায়। দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মোহাম্মদ বিন তুঘলক নিজের ভুল বুঝতে পেরে চার বছর পর তার নতুন মুদ্রা প্রত্যাহার করে নেয়। রাজকোষ থেকে প্রতিটি ব্রোঞর মুদ্রার পরিবর্তে স্বর্ণ ও রুপার মুদ্রা দিয়ে তা পূরণ করেন। দুর্গের বাইরের স্তূপীকৃত মুদ্রা জমা হয়ে বহুদিন পড়েছিল। তার বিবরণ বারনি আমাদের দিয়েছেন।। 

মোহাম্মদ বিন তুঘলকের তিনটি পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়েছিল। তার ব্যর্থতার জন্য তিনি একমাত্র দায়ী ছিলেন বা পরিকল্পনা গুলি উদ্ভট ছিল তা বলা যায় না। প্রতিটি পরিকল্পনাতেই তার মৌলিক চিন্তার স্বাক্ষর ছিল। পরিকল্পনা গুলি ব্যার্থ হয়েছিল বলে তাকে খামখেয়ালী বা পাগলা হিসেবে অভিহিত করা যায় না। নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে দেখা যায় তিনি উলেমাদের ও অভিজাতদের মতামত অনুযায়ী কোন কাজ করতে পছন্দ করতেন না। বরং রাজনৈতিক প্রয়োজন সিদ্ধির উপযোগী কাজ করতে পছন্দ করতেন। এই কারণেই সমসাময়িক উলামাগণ তুঘলককে বিধর্মী ও নিষ্ঠুর বলে নিন্দা করেছেন। সকল ব্যর্থতার জন্য তিনি দায়ী ছিলেন এই অভিমত যথার্থ নয় সমকালীন নিয়ন্ত্রণাধীন পরিস্থিতি এই ব্যর্থতার জন্য অপেকৃত অনেকখানি দায়ী ছিল। তার রাজত্বের ১০ বছর ধরে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ হয়। এবং দুর্ভিক্ষ পীড়িত জনসাধারণ সুলতানের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। কিন্তু তিনি দুর্ভিক্ষ নিবারনের জন্য কূপ খনন, কৃষি ঋণ, খাজনা মুকুব, নানা ধরনের ফসলের চাষ কল্যাণকর বহু ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বারনি ও ইসামী, বতুতার বিবরণ কে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তার পরিকল্পনার গুলির পিছনে দেশের কল্যাণ করার ইচ্ছা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। তিনি যে সকল পরিকল্পনা গ্রহণ করেন সেগুলি সে যুগে এত অপরিচিত ছিল যে সেগুলি জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনা তা জনসাধারণ উপলব্ধি করতে পারেনি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...