ইলিয়াস শাহী বংশের পতনের পর হাবসি শাসন ছিল বঙ্গদেশের এক অন্ধকারময় যুগ। বঙ্গদেশের জনসাধারণ এই হাবসি শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। নিজামুদ্দিনের মতে মোজাফফর শাহের বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান উজির সৈয়দ হুসেন বাংলাদেশকে এই সংকট থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেন। ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ হুসেন মোজাফফর কে হত্যা করে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন।
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ ছিলেন হুসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা । আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কুশাসন থেকে বঙ্গদেশ কে মুক্ত করে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করেছেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি হাবসি প্রাসাদ রক্ষী সেনাদলের ক্ষমতা সংকুচিত করে এবং তাদের বঙ্গদেশ থেকে বিতাড়িত করে, মুঘল ও আফগানদের উচ্চ পদে নিয়োগ করেন। পুরাতন আমলের কর্মচারীদের বরখাস্ত করে, তিনি সদর দপ্তরে নতুন ও নিজের অনুগত লোকদের নিয়োগ করে। দেশের সর্বত্র অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলতা কঠোর হাতে দমন করেন। বহু ধন সম্পত্তি উদ্ধার করে। ফিরিস্তার মতে তখন ধনী ব্যক্তিরা উৎসবে সোনার থালা ব্যবহার করতেন। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এরকম প্রায় ১৩০০ সোনার থালা উদ্ধার করেন।
তাঁর সিংহাসন আরোহণের সময় সমগ্র উত্তর ভারতে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য চলছিল এবং উত্তর ভারতের অধিকাংশ শাসক তখন স্বাধীন হয়ে যায়। এই সুযোগে হুসেন শাহ বঙ্গদেশের তিন খন্ড কে একই সর্বভৌম ক্ষমতার অধীনে এনে বঙ্গদেশের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে জৌনপুরের রাজ্যচ্যুত সুলতান হোসেন শাহ শার্কি দিল্লির সুলতান সিকান্দার এর কাছে পরাজিত হয়ে বঙ্গদেশে পালিয়ে আসেন। এবং বাংলাদেশের সুলতান হোসেন শাহ শার্কী কে আশ্রয় দেন। এতে ক্রদ্ধ হয়ে সিকান্দার শাহ বঙ্গদেশের বিরুদ্ধে এক বাহিনী প্রেরণ করেন। শেষ পর্যন্ত উভয় পক্ষের মধ্যে এক সন্ধি হয়। বলা হয় এই সম্মানজনক সন্ধি হুসেন শাহের মর্যাদা ও প্রাধান্য বৃদ্ধি করে। এছাড়াও তিনি আসামের কামতা রাজ্য আক্রমণ করেন ও উড়িষ্যার সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে লিপ্ত হন। এছাড়াও কামরূপ এবং উড়িষ্যা ও ত্রিপুরা সাময়িকভাবে তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এমনকি পর্তুগিজদের বিতাড়িত করে বাংলায় নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছিলেন। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ বঙ্গদেশের সুলতানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। তাকে বঙ্গদেশের আকবর হয়। তাঁর রাজত্বকালে বঙ্গদেশে শান্তি ও সমৃদ্ধি চরম শিখরে আরোহণ করেছিল।
তাঁর মৃত্যুর মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র নুসরৎ শাহ বঙ্গদেশের সিংহাসন আরোহন করেন। তাঁরও পিতার মতোই মানবিক গুণ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিল। তাঁর আমলে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়। গুলাম হোসেন সেলিমের লেখা থেকে জানা যায় তিনি ত্রিহুত জয় করে সেখানকার শাসনভার তার দুই শালকের হাতে হস্তান্তর করেন। তবে তার বিচক্ষণার পরিচয় পাওয়া যায় ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে বাবর ক্ষমতা লাভ করলে, পরাজিত আফগানরা পূর্বদিকে সরে এসে তার অস্তিত্বের বিঘ্ন ঘটাতে পারে এই আশঙ্কায় বিচক্ষণ নুসরৎ শাহ বাবরের সঙ্গে সন্ধি করেন। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে বাবরের মৃত্যুর পর পুনরায় নুসরৎ শাহ পূর্বাঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য উদ্যোগী হয়। তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য বাবরের পুত্র হুমায়ুনের উদ্যোগ দেখে নুসরৎ শাহ গুজরাটের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। এতে তার উদ্দেশ্য সফল হয় হুমায়ুন আপাতত বঙ্গদেশ অভিযান স্থাপিত রাখেন। নুসরৎ শাহের মৃত্যুর পর তার পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ সিংহাসন আরোহন করেন। তার রাজত্বকাল তিন মাস স্থায়ী হয়েছিল। গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ ছিলেন এই বংশের শেষ প্রতিনিধি।
বঙ্গদেশের ইতিহাসে ইলিয়াস শাহী বংশের সার্থক উত্তরাধিকারী ছিল হোসেন শাহী বংশ। প্রকৃতপক্ষে হুসেন শাহী বংশের শাসনকালে বাংলাদেশ আধুনিকতার পথে উত্তরণ ঘটে। এই বংশের প্রথম দুই সুলতান হুসেন শাহ এবং নুসরৎ শাহ ছিলেন উদার ও প্রজাহিতৈষণার মুর্ত প্রতীক। সিকান্দার লোদী ও বাবরের মতো দুর্ধর্ষ সামরিক নেতাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে বঙ্গদেশের স্বাধীনতা যেভাবে রক্ষা করেছিলেন তা মধ্যযুগের বঙ্গদেশের ইতিহাসে হোসেন শাহী বংশের গৌরবময় ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
হুসেন শাহ বারবাক শাহের সৃষ্ট উদারনীতিকে সযত্নে লালন করেছিলেন। শাসনব্যবস্থায় যোগ্য ব্যক্তিকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে উপযুক্ত পদে নিয়োগ করেন। বিশেষ করে হিন্দুদের উচ্চ পদে নিয়োগ করে এক উদার মানসিকতার পরিচয় দেন। হুসেন শাহের উজির ছিলেন গোপীনাথ বসু, তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন মুকুন্দ দাস, তার দেহ রক্ষির প্রধানও ছিলেন হিন্দু, তার টাকশালের অধ্যক্ষ ছিলেন হিন্দু, তার সেনাপতি ছিলেন গৌর মল্লিক, ভ্রাতা সনাতন ও রূপ গোস্বামী হুসেন শাহেব পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। এদের একজন ছিলেন সুলতানের একান্ত সচিব।
হুসেন শাহী রাজবংশে রাজত্বকালে শ্রী চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ঘটেছিল। বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের ফলে বঙ্গদেশেও সামাজিক ও ধর্মনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে নবজাগরণের সূচনা হয়। ডঃ হাবিবুল্লাহ মনে করেন হোসেন শাহী বংশের এই উদারনৈতিক শাসনতান্ত্রিক পরিমণ্ডল ও পরম পরধর্ম সহিষ্ণু শাসন না থাকলে শ্রীচৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার ও প্রসার এবং মধ্যযুগে বঙ্গদেশে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ সম্ভব হতো না। ঐতিহাসিক তথ্য থেকে সমর্থিত হয়েছে যে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ শ্রী চৈতন্যদেব কে শ্রদ্ধা করতেন এবং তার অসাধারণত্ব স্বীকার করেছিলেন।
হুসেন শাহী বংশ বঙ্গদেশের সংস্কৃতিক জগতকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করে। মধ্যযুগের বঙ্গদেশে এই সাংস্কৃতিক বিকাশ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। যার প্রতিফলন ঘটে বঙ্গভাষার ও সাহিত্যের প্রতিটি পর্বের ভাবের আদাল প্রদানে। চৈতন্যদেব যে শুধু ভক্তিবাদকে ধর্মীয় রূপ দিয়েছিল তা নয় বঙ্গ সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এক নতুন যুগের সূচনা করে। চৈতন্যচরিত গ্রন্থ গুলি বিশেষ করে চৈতন্য ভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত, বিপ্রদাসের মনসামঙ্গল, হুসেন শাহী বংশের রাজত্বকালের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ফসল। পদাবলী সাহিত্যের সঙ্গে ও হুসেন শাহী বংশের নাম ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এছাড়াও মালাধর বসু, বিজয় গুপ্ত, যশরাজ খান, হুসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। তার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে মালাধর বসু শ্রীমদ্ভগবদগীতা বাংলায় অনুবাদ করেন। রূপ গোস্বামী ললিত মাধব ও বিদগ্ধ মাধব দুখানি গ্রন্থ রচনা করে। হুসেন শাহী বংশের রাজত্বকালে পরমেশ্বর নামে জনৈক পন্ডিত মহাভারত এর বাংলা অনুবাদ করেন।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও হোসেন শাহী বংশের বাংলা ছিল এক সমৃদ্ধ রাজ্য। ব্যবসা বাণিজ্যেও বাংলা ছিল খুবই সমৃদ্ধ। বৈষ্ণব পদাবলী ও মঙ্গলকাব্য হতে সে যুগের ব্যবসা বাণিজ্য ও এক সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। বাংলায় বণিক যে বঙ্গোপসাগর পার হয়ে ব্রহ্মদেশ, ইন্দোচীন ও ইন্দোনেশিয়ায় বাণিজ্য করত করতে যেত সে তথ্য পাওয়া গেছে।
কৃষি ও শিল্পের উন্নতি লাভ করার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে যে খ্যাতী অর্জন করেছিল তা বিদেশী পর্যটকদের বিবরণে পাই। মনসা মঙ্গল ও কবিকঙ্কন এ বাঙালিদের সাগর পাড়ি দিতো তার পরিচয় পাওয়া যায়। পেরিপ্লাসে বঙ্গ দেশের তমলুক, সপ্তগ্রাম বন্দরের নাম উল্লেখিত আছে। সপ্তগ্রাম বন্দর মধ্য যুগের সাহিত্যের নৌ বাণিজ্যের কেন্দ্র বলে পরিচিত ছিল এবং প্রাচীন তাম্রলিপ্ত বন্দর এর স্থান অধিকার করেছিল। তৎকালীন বাংলায় সাতগাঁও, সোনারগাঁও, চট্টগ্রাম বন্দর ছিল বিদেশীদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে চিনি ও বস্ত্র শিল্প রপ্তানি করা হতো। বাংলাদেশে গাছের ডাল থেকে উৎকৃষ্ট কাগজ তৈরি হতো। গুড উৎপাদনে বঙ্গদেশের খ্যাতি ছিল।
স্থাপত্য শিল্পের পৃষ্ঠ পোশাক হিসেবেও হোসেন শাহী বংশের যথেষ্ট অবদান আছে। শিল্প স্থাপত্যের মধ্যে অন্যতম ছিল ছোট সোনা মসজিদ, বড় সোনা মসজিদ, লোটন মসজিদ, কদম রসুল, দাখিল দরজা, একলাকি সমাধি মন্দির প্রভৃতি স্থাপত্যের ক্ষেত্রে নতুনত্বের পরিচয় এ যুগে পাওয়া যায় না। তবে এই স্থাপত্য গুলি স্থায়িত্বের দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছিল এই যুগে।
হুসেন শাহ প্রতিটি জেলায় মসজিদ ও হাসপাতাল নির্মাণ করে এ ব্যাপারে কুতুব-উল-আলম নামে জনৈক জ্ঞানী ব্যক্তির সমাধি নির্মাণ ও তার নামে একটি শিক্ষা পতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। হুসেন শাহের মতো বঙ্গদেশের কোন সুলতানই বাঙালি জাতির এমন সার্বজনীন আতিথ্য পাননি। বাঙালি জাতিও তাকে 'নৃপতি তিলক' 'জগত ভূষণ' উপাধি দিয়ে বরণ করে নিয়েছিলেন। তার মহৎ ব্যক্তিত্ব দয়া ও ন্যায় বিচারের জন্য সমসাময়িক লেখকগণ তাকে কৃষ্ণের অবতার বলেও অভিহিত করেছেন।
ডঃ হাবিবুল্লাহ বলেছেন যে হুসেন শাহের দুর্ভাগ্য যে আবুল ফজলের মত তার জীবনীকার ছিল না যদি থাকতো তাহলে তার জীবন আমাদের কাছে আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠতো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন