কণিষ্কের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে কুষান শাসকদের রাজনৈতিক অবদান আলোচনা কর।
খ্রিস্টিয় প্রথম শতক নাগাদ উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকার উপর শকদের কর্তৃত্ব ক্রমশ অন্তর্হিত হতে থাকে এবং একটি নতুন শক্তির অভ্যুদ্বয় হয়। এই নতুন রাজশক্তি হল কুষাণ। মধ্য এশিয়া থেকে বেরিয়ে যে সমস্ত যাযাবর গোষ্ঠী পশ্চিম দিকে অভিপ্রয়ান করে আফগানিস্তান এবং উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তদেশে উপস্থিত হল তাদের মধ্যে একটি গোষ্ঠী ছিল ইউ-চি। সাম্প্রতীক গবেষণায় দেখা গেছে এরা ইন্দো-ইউরোপীয় 'তোখারীয়' ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই ইউ-চি গোষ্ঠীর ৫ টি শাখার মধ্যে একটি শাখা ছিল কুষান, যাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সূচনা হয়েছিল ব্যাকট্রিয়া থেকে এবং ধীরে ধীরে তারা উপমহাদেশের বিরাট ভূখন্ডের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই রাজবংশের শ্রেষ্ঠ শাসক কণিষ্ক, যিনি কেবল রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের জন্যই খ্যাতি অর্জন করেননি, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
কুষাণদের রাজনৈতিক ইতিবৃত্তের পরিচয় পাওয়া যাবে মুদ্রাগত সাক্ষ্য, বিভিন্ন লেখ এবং চিনা বিবরণ থেকে। প্রথম কুষাণ শাসক ছিলেন মিয়াওস। তাঁর অধিকার বাহ্লীক দেশ ছাড়াও আমুদরিয়া নদীর উত্তরস্ত এলাকায় ছিল বলে ঐতিহাসিকগন অনুমান করেন। কুষানদের রাজনৈতিক বিস্তৃতির সূচনা হয় কুজুল কদফিসেসের সময় থেকে। চীনা তথ্যসূত্র অনুযায়ী কাবুল ও কাশ্মীর তাঁর অধিকারে এসেছিল। তাঁর পুত্র বিম কদফিসেস নিম্ন সিন্ধু অববাহিকা ও সিন্ধু ব-দ্বীপ এলাকা দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর সাম্রাজ্য মথুরা পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। তিনিই প্রথম শাসক যিনি ভারতীয় শাসকদের ন্যায় মহারাজ, রাজাতিরাজ, সর্বলোকেশ্বর ইত্যাদি উপাধি ধারন করেছিলেন, যা তাঁর ভারতীয় এলাকার উপর কর্তৃত্বের প্রমান দেয়। তাঁর হাতেই প্রথম ভারতে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন হয়েছিল।
কুষাণ সাম্রাজ্য তাঁর ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছায় কণিষ্কের শাসনকালে। তিনি ২৩ বছর রাজত্ব করেছিলেন। দীর্ঘ বিতর্কের পর ঐতিহাসিকগন মোটামুটিভাবে একমত হয়েছেন যে ৭৮ খ্রিস্টাব্দ তাঁর সিংহাসন আরহনের কাল। এই সময় থেকেই তিনি নতুন অব্দ (শকাব্দ) চালু করেন যা তাঁর উত্তরসূরীরা ১৭০ বছর ধরে ব্যবহার করেছিলেন। কণিষ্কের রবাতক লেখ থেকে তাঁর সাম্যাজ্যের বিস্তৃতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। এই লেখ অনুশারে উজ্জয়ীনি, সাকেত, কোশাম্বী, পটলিপুত্র ও শ্রী-চম্পা (ভাগলপুর) এলাকায় তাঁর আদেশ পালিত হত। অর্থাৎ কণিষ্ক তাঁর কর্তৃত্ব পূর্ব দিকে পাটলিপুত্র ও ভাগলপুর পর্যন্ত বিস্তৃত করলেন। অর্থাৎ গাঙ্গেয় উপত্যকা তাঁর অধিকারে এল। তাঁর এই কর্তৃত্বের আরও প্রমান কৌশাম্বী ও সারনাথ থেকে পাওয়া তাঁর দুটি লেখ।
পূর্ব পুরুষের অধিকৃত পশ্চিম ভারতীয় এলাকার উপর তাঁর অধিকার বজায় ছিল। মথুরার উপর যে তাঁর অবিসংবাদী কর্তৃত্ব ছিল তাঁর প্রমান পাওয়া যাবে তাঁর রাজত্বকালের অন্তিম (২৩ তম) বর্ষে উৎকীর্ণ মথুরা থেকে প্রাপ্ত একটি লেখ। তাঁর রাজত্বকালের ২২ তম বর্ষে উৎকীর্ণ সাঁচী থেকে একটি লেখ পাওয়া গেছে। শ্রাবস্তী থেকে প্রাপ্ত লেখ প্রাচীন কোশলের উপর কর্তৃত্বের প্রমান দেয়। বর্তমান পাকিস্তানের প্রায় সমস্ত এলাকার উপর তাঁর কর্তৃত্ব ছিল। এরকমও অনুমান অমুলক নয় যে পশ্চিম ভারতের দুই শক ক্ষত্রপ চষ্টন ও তাঁর পৌত্র রুদ্রদামন কুষাণদের অধীনস্ত প্রাদেশিক শাসক ছিলেন। তাহলে কুষাণ সাম্রাজ্য গুজরাট তথা কাথিয়াবাড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলা যেতে পারে।
ব্যকট্রিয়া যথারীতি কণিষ্কের মূল কেন্দ্র ছিল। কনিষ্কের সময় থেকে কুষান মুদ্রায় পাকাপকিভাবে গ্রীক ভাষার পরিবর্তে ব্যাকট্রিয় ভাষার ব্যবহার হত। কণিষ্কের রবাতক লেখটি ব্যাকট্রিয় ভাষায় লেখা। এর থেকে অনুমান করাই যায় কুষান সাম্রাজ্যে সেইসময় ব্যাকট্রিয় এলাকার তাৎপর্য কতটা বেশি। পরবর্তীকালে আগত চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের বিবরণে ব্যাকট্রিয়ার উপর তাঁর কর্তৃত্বের কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয় পামির এলাকার পূর্ব দিক পর্যন্ত তাঁর ক্ষমতা বিস্তারের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। কণিষ্কের আমলে কুষান সাম্রাজ্যের যে বিরাট বিস্তৃতি ঘটে তাঁর ফলে কাশগড়, খোটান, সোগদিয়ানা, তাশখন্দ প্রভৃতি মধ্য এশীয় এলাকা কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এর ফলে চীনের হান রাজাদের সাথে তাঁর বিরোধের সূত্রপাত হয়। চিনা সুত্র থেকে জানা যায় তিনি ৯০ খ্রিস্টাব্দে চিনের বিরুদ্ধে অভিযান পাঠিয়েছিলেন কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন।
কণিস্কের পর থেকে কুষাণ সাম্রাজ্য ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকে। কণিষ্কের পরবর্তী শাসক বাসিষ্কর রাজত্বকালে মথুরার পূর্ব দিকের এলাকার উপর কুষাণদের কর্তৃত্ব ছিল কি না সেবিষয়ে নিশ্চিত কোনো প্রমান নেই। তবে মথুরা ও ব্যাকট্রা এলাকার উপর কুষাণদের কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো সংশয় নেই। তাঁর পরবর্তী শাসক হুবিস্কর সময় কুষাণরা নিঃসন্দেহে মথুরার পূর্ব দিকের এলাকার উপর কর্তৃত্ব হারিয়েছিল। তবে পশ্চিম দিকের এলাকার উপর তাঁর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ছিল। এই সময় যুগ্ম শাসক হিসাবে দ্বিতীয় কণিষ্কের কথা জানা যায়। হুবিস্কের পর প্রথম বাসুদেবের সময় গুজরাটে স্বতন্ত্র শাসক হিসাবে শক ক্ষত্রপ রুদ্রদামনের উত্থান হয়। প্রথম বাসুদেবের পর আরও দুজন কুষাণ শাসকের নাম পাওয়া যায়- তৃতীয় কণিষ্ক এবং দ্বিতীয় বাসুদেব। শেষ শাসক দ্বিতীয় বাসুদেব মথুরার উপর নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু কুষাণদের রাজনৈতিক ক্ষমতার মূল কেন্দ্র ব্যাকট্রা ইরানের সাসানীয় শক্তির আক্রমণে হাতছাড়া হয়ে যায়। কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল, এ এস অল্টেকর প্রমুখ ঐতিহাসিকগন কুষাণদের পতনের জন্য অরাজতান্ত্রিক গনরাজ্যগুলির (যেমন- যৌধেয়, মালব প্রভৃতি) প্রবল বিরোধিতাকে দায়ী করেন। কিন্তু ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মনে করেন কুষানদের পতনের আসল কারন ব্যাকট্রিয়া হস্তচ্যুত হওয়া। এর ফলে সাম্রাজ্যের ভীত আলগা হয়ে পড়েছিল এবং কুষানদের অস্তিত্ব তখন মুমূর্ষু একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছিল, যাকে সহজেই পরাজিত করা যেত।
Discuss the Political Contributions of the Kushan Rulers with Special Emphasis on Kanishka
Around the 1st century CE, the dominance of the Shakas in the northwestern frontier of the Indian subcontinent began to wane, paving the way for the rise of a new power—the Kushans. Among the nomadic tribes migrating westward from Central Asia, a group known as the Yuezhi reached Afghanistan and the northwestern borders of the subcontinent. Modern research identifies the Yuezhi as part of the Indo-European "Tocharian" linguistic group. The Kushans, one of the five branches of the Yuezhi, started their political ascendancy from Bactria and gradually extended their control over a vast territory of the subcontinent. The greatest ruler of this dynasty, Kanishka, not only earned fame for his extensive political conquests but also left a significant mark on religious and cultural spheres.
Evidence of the Kushan political history is found in numismatic records, inscriptions, and Chinese chronicles. The first Kushan ruler, Kujula Kadphises, is believed to have ruled over Bactria and the northern regions of the Oxus River. Under Kujula, the Kushans began their territorial expansion. According to Chinese sources, Kabul and Kashmir fell under his control. His son, Vima Kadphises, extended his empire to the lower Indus valley and the delta region. His kingdom stretched as far as Mathura, and he was the first ruler to adopt Indian royal titles such as Maharaja, Rajatiraja, and Sarvalokeshvara, signifying his authority over Indian territories. Vima Kadphises is also credited with introducing gold coinage in India.
The Kushan Empire reached its zenith during Kanishka's reign, which lasted 23 years. After much scholarly debate, it is now broadly accepted that he ascended the throne in 78 CE, marking the beginning of the Shaka Era, which was used by his successors for 170 years. The Rabatak inscription provides critical information about the extent of his empire. It mentions cities such as Ujjain, Saket, Kausambi, Pataliputra, and Champa, indicating that Kanishka’s authority extended as far east as Pataliputra and Bhagalpur in the Gangetic valley.
Evidence of his rule in the Gangetic valley comes from inscriptions found in Kausambi and Sarnath. His control over western India is attested by inscriptions from Mathura (dated to his 23rd regnal year) and Sanchi (22nd regnal year). Inscriptions from Shravasti confirm his dominance over ancient Kosala. His authority likely extended over most of present-day Pakistan, and it is not improbable to suggest that the Shaka satraps of Gujarat, such as Chastana and Rudradaman, were provincial governors under the Kushans. Thus, the empire may have stretched as far as Gujarat and Kathiawar.
Bactria remained the core of the Kushan Empire during Kanishka’s reign. From this period onward, Kushan coins began using the Bactrian language instead of Greek. The Rabatak inscription, written in Bactrian, underscores the significance of this region. Later, the Chinese pilgrim Xuanzang also noted Kanishka’s control over Bactria, highlighting its importance within the empire. The empire’s vast expansion into regions like Kashgar, Khotan, Sogdiana, and Tashkent integrated these Central Asian territories into the Kushan domain. This territorial growth led to conflicts with China’s Han dynasty, and Chinese sources mention Kanishka’s unsuccessful expedition against China in 90 CE.
After Kanishka, the empire gradually shrank. His successor, Vasishka, likely retained control over Mathura but lost territories east of it. Under Huvishka, the empire indisputably lost control over eastern regions but maintained its dominance in the west. Joint rule by another Kanishka II is also recorded. During Vasudeva I’s reign, the Shaka satrap Rudradaman emerged as an independent ruler in Gujarat. Two more rulers, Kanishka III and Vasudeva II, are mentioned in later records.
The Kushans eventually lost their stronghold in Bactria to the Sassanian Empire of Iran. Scholars like Kashi Prasad Jayaswal and A. S. Altekar attribute the Kushan decline to resistance from republican polities like the Yaudheyas and Malavas. However, B. N. Mukherjee emphasizes that the loss of Bactria was the primary reason for the empire’s downfall, destabilizing its foundation and reducing the Kushans to a feeble power.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন