উপনিবেশিক ভারতে খেলা ও সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্ক
খেলাধুলো আমাদের দৈনন্দিন সামাজিক ও সংস্কৃতিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু সংস্কৃতি চর্চায় বা ইতিহাস চিন্তায় খেলাধুলো কোনোদিন গভীর ও গৌরবের স্থান পায়নি। উপনিবেশিক ও উত্তর ঔপনিবেশিক ভারতে তথা দক্ষিণ এশিয়ায় খেলা বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকেছে। ১৯ ও ২০ শতকের ভারতে খেলার সামাজিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা, দেশভাগ, শরণার্থী সমস্যা, কূটনীতি, বাণিজ্যিকতা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় গুলি খেলার বিবর্তনের ইতিহাসে প্রতিফলিত আছে।
উপনিবেশিক ভারতে খেলার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্ক ফুটবল, ক্রিকেট দুই খেলার সামাজিক ইতিহাসের মধ্যে স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। ফুটবলের ক্ষেত্রে দেখি ১৯৩০- ৪০ এর দশকের বাঙালির জাতীয়তাবাদী ক্রীড়াসত্তায় সাম্প্রদায়িকতার মত এক লক্ষণ এক অবাঞ্ছিত বিভাজন সৃষ্টি করে যা তৎকালীন সম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে হিংসা রূপ ধারণ করেছিল। কলকাতার মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে কেন্দ্র করে ক্রিড়া ক্ষেত্রে মুসলিম প্রতিনিধিত্বের সূচনা হয় ১৮৮৭ সালে। তবে মহামেডান যে প্রথম থেকে সম্প্রদায়িক চরিত্র প্রকাশ করেছিল এ কথা আদৌ বলা যায় না, ১৯১১ সালে মোহনবাগানের শিল্ড বিজয়ের লগ্নে হিন্দু ভাইদের বিজয় উৎসবে মুসলিমরাও যথেষ্ট উৎসাহিত ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামিল হয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে মুসলিম লীগের প্রভাব বৃদ্ধি এবং ১৯২০ দশকের হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের অবনতির প্রেক্ষাপটে খেলার মাঠে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল। ১৯৩০ দশকে ইংরেজ দলগুলোকে পরপর পাঁচবার মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব পরাস্ত করেছিল। কিন্তু এটা দুর্ভাগ্যজনক মহামেডানের এই জয়ে হিন্দু সমাজ ততটা উল্লাসিত হয়নি। আর এই জন্যই বোধহয় অনেক বড় মাপের কৃতিত্ব দেখানো সত্বেও মহামেডান ফুটবল বিজয়ের কাহিনী মোহনবাগানের শিল্ড জয় এর তুলনায় একদম উপেক্ষিত থেকে গেছে।
১৯৩০ দশকে বাংলাদেশে কৃষক প্রজা পার্টি ও ফজলুল হকের শাসনকালে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে মোহামেডানের ফুটবল সাফল্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। এর ফলে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা, পরগনা ও মফঃস্বলে মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাব গঠনের উদ্যোগ শুরু হয়। মুসলিম লীগ ও কৃষক প্রজা পার্টির রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠান মহামেডান কে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট বেআইনি সরকারি সাহায্য দিয়েছিল। তার প্রমাণও পাওয়া যায়। হিন্দুরা সম্ভবত এই ধরনের সরকারি একদর্শিতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন।
অধ্যাপক সুরঞ্জন দাস ১৯৪৬ সালে কলকাতার দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবকে কেন্দ্র করে যে Self Mobilization এর ইঙ্গিত দিয়েছেন তা কিন্তু শুধু মুসলিমদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তানিয়া সরকার মন্তব্য করেছেন ১৯২০ দশকের থেকে ক্রিড়াভিত্তিক হিন্দু শরীরশিক্ষা বা স্বেচ্ছাসেবী গঠনের সক্রিয়তা মুসলমানদের মধ্যে আশঙ্কার সৃষ্টি করে এবং তাদের পাল্টা প্রস্তুতি গ্রহণে উত্তেজিত করে। বিশেষত দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে ময়দানি হিংসার একটা সাম্প্রদায়িক চরিত্র এ সময় প্রকাট হয়ে পড়ে।
উপনিবেশিক ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসেও সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। ১৯৩০-৪০ দশকে বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত পেন্টাগুলার প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠনের পিছনে এই সাম্প্রদায়িক কারণই প্রধান ছিল বলে প্রচলিত ঐতিহাসিক ধারণা বিদ্যমান। ১৮৯০ এর দশক থেকে বোম্বাই শহরের সামরিক জিমখানাদের পরিচালনায় ইউরোপীয়, পার্সি, হিন্দু, মুসলিম এবং অবশিষ্ট পাঁচটি সম্প্রদায় ভিত্তিক দলকে নিয়ে সংগঠিত এই প্রতিযোগিতা শুধু যে জনপ্রিয় ছিল তা নয় অর্থনৈতিক দিক থেকেও এটি চূড়ান্ত লাভজনক হয়ে উঠেছিল। প্রচলিত ঐতিহাসিক ধারণা অনুযায়ী পেন্টাগুলার প্রতিযোগিতার সাম্প্রদায়িক চরিত্রের বিরুদ্ধে যে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু হয় তারই ফলস্বরূপ শেষ পর্যন্ত ১৯৪৬ সালে এই প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে ১৯৩০ এর দশকে এই সাম্প্রদায়িক প্রতিযোগিতা কে গান্ধীবাদী ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে চলতে দেওয়া সম্ভব নয়।
অতি সম্প্রতি ক্রিকেট ঐতিহাসিক মহলের এই প্রচলিত ব্যাখ্যাকে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে নতুন তথ্যের আলোকে খণ্ডন করেছেন বোরিয়া মজুমদার। তার মতে পেন্টাগুলার প্রতিযোগিতার সমাপ্তির মূলে এই প্রতিযোগিতার সাম্প্রদায়িক সংগঠনের বিরূদ্ধে আন্দোলন ছিল একটা অজুহাত মাত্র। আসল কারণ আমাদের খুঁজতে হবে সে যুগের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে। বোম্বে তথা ভারতীয় সমাজে বাণিজ্যকারণ, পেশাদারীকরণ ও আমলাতান্ত্রিকরণের নতুনতর প্রভাবের মধ্যে। বোরিয়া দেখেছেন সাম্প্রদায়িকভিত্তিক হলেও পেন্টাগুলার ম্যাচকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক তিক্ততা সৃষ্টি কিংবা হিংসার উদ্ভব প্রায় ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল। আসলে ১৯২৮ সালে স্থাপিত BCCI ১৯৩৪ সালে অঞ্চল ভিত্তিক রণজি ট্রফির প্রবর্তন করলে ওই প্রতিযোগিতা পেন্টাগুলার প্রতিযোগীতার বিপুল জনপ্রিয়তার দাপটে একেবারে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। স্বভাবতই বিসিসিআই এবং তার পরিচালক ও পৃষ্ঠপোষকগন বোম্বে পেন্টাগুলার প্রতি তীব্র ঈর্ষা পরায়ণ হয়ে ওঠেন এবং রণজি ট্রফিকে জনপ্রিয় করতে হলে এই প্রতিযোগিতার পরিসমাপ্তি ঘটানো অবশ্যক তা উপলব্ধি করেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী প্রতিবাদের যুক্তিকে ব্যবহার করে তারা পেন্টাগুলার বিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়ে। অথচ প্রায় একই সময়ে বোম্বে কংগ্রেস সরকার সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে শহরের স্নানাগার ব্যবহারের সময় নির্ধারণ করে দিলে, তার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ হয়নি।
সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং সম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ভিত্তিক ক্রিকেটের উর্ধ্বে আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব এ ধরনের স্বার্থ রক্ষার দোহাই দিয়ে জনপ্রিয় ও আর্থিক দিক থেকে লাভজনক পেন্টাগুলার প্রতিযোগিতাকে বন্ধ করা প্রমাণ করে যে ১৯৩০-৪০ দশকের থেকেই ভারতীয় ক্রিকেটের বিবর্তনকে নগরায়ন ও বাণিজ্যিকরণের মতো নতুন আত্মসামাজিক শক্তিগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন