আদি মধ্যযুগের ইতিহাস চর্চায় সাহিত্যিক উপাদান
সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ভারতবর্ষে আদি মধ্যযুগ। এই যুগে রচিত ইতিহাস গ্রন্থ বলতে একমাত্র রাজতরঙ্গিনী। তবে ইতিহাস গ্রন্থের অভাব থাকলেও ইতিহাস চর্চা অসাধ্য হয় নি। সাহিত্যিক উপাদানের প্রতুলতা এবং বহু লিপি ও মুদ্রা এই পর্বের ইতিহাস চর্চায় কাজে আসে।
আদি মধ্যযুগের সবচেয়ে বড় উপাদান হল সাহিত্য। এই পর্বে রাজার গুণকীর্তন করে প্রচুর জীবনচরিত লেখা হয়। চালুক্য রাজ ষষ্ঠ বিক্রমাদিত্যের জীবন নিয়ে বিক্রমাঙ্কদেবচরিত রচনা করেছেন বিলহন। সন্ধ্যাকর নন্দী রচনা করেছিলেন রামচরিত। এটি দ্ব্যর্থক ভাষায় লেখা। এখানে পাল রাজা রামপাল এবং ভগবান রামচন্দ্রের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। জৈন গুরু জয়সিংহ দ্বাদশ শতকের চালুক্য বংশীয় শাসক কুমার পালের জীবনী কুমারপালচরিত রচনা করেছিলেন। সিন্ধু রাজা নবশশাঙ্কের জীবনী নবশশাঙ্কচরিত রচনা করেছেন পদ্মগুপ্ত। এছাড়াও আছে চাঁদ বরদৈ রচিত পৃথ্বীরাজ রাসো। এই জীবন রচিত গুলির নিরপক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কারন এ ক্ষেত্রে প্রভুর প্রতি পক্ষপাতিত্ব থেকে যায়। তাই জীবনচরিতের তথ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকদের সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।
আদি মধ্যযুগে রচিত হয়েছে একাধিক পুরান। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরান, ভাগবত পুরাণ থেকে এযুগের দুই বাংলার আর্থ-সামাজিক ইতিহাস জানা যায়। স্কন্দপুরাণ পশ্চিম ভারতের সামাজিক ইতিহাসের নানা তথ্য পাওয়া যায়। রামশরণ শর্মা তার যে সামন্ততন্ত্র তত্ত্ব খাড়া করেছেন তা অনেকখানি পুরাণের তত্ত্ব নির্ভর। আলচ্য পর্বে ধর্মশাস্ত্রগুলির উপর যে টীকা ও ভাষ্য রচিত হয়েছিল সেগুলিও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাদেশিক ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল কলহনের রচিত রাজতরঙ্গিনী। এটিই একমাত্র সে যুগের বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস গ্রন্থ। তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং ঐতিহাসিক নিরপেক্ষতা'র প্রতি কলহন নিষ্ঠাবান ছিলেন। এই গ্রন্থে সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত কাশ্মীরের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস তিনি লিখেছিলেন। তথ্যের অভাবে প্রাক সপ্তম শতকের ইতিহাস লিখতে তিনি পারেননি-- তাও তিনি উল্লেখ করেছেন। কলহনের অনুশরণে গুজরাটের ও নেপালের আঞ্চলিক ইতিহাস লেখার চেষ্টা হয়েছিল। সোমেশ্বর লিখেছেন ও কীর্তি কৌমুদী। মেরূতুঙ্গ লিখেছেন প্রবন্ধ চিন্তামণি, বাল চন্দ্র লিখেছেন বসন্ত বিলাস, নেপালে লেখা হয়েছিল বংশাবলি।
এমন কতকগুলি রচনা আছে যা থেকে সমকালীন কৃষি, কারিগরি উৎপাদন এবং ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া যায়। কৃষি বিষয়ক দুটি গ্রন্থ হল কৃষিসূক্তি ও কৃষি পরাশর। দেশীনামমালা গ্রন্থ থেকে বাণিকদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। সোমেস্বর প্রনীত মানসোল্লাস থেকে সমসাময়িক স্থাপত্য বিদ্যার পরিচয় পাওয়া যায়।
বিদেশি সাহিত্য আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই বলা যায় চৈনিক সাহিত্যের কথা। বৌদ্ধ ধর্মের টানে বহু চিনা পরিব্রাজক ভারতে এসেছেন এবং তাঁদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত রচনা করেছেন। ইৎ-জিং ভারত পরিভ্রমণ করে রচনা করেছিলেন কাউ-ফা-স্যাং-চুয়েন। সুয়ান জাং রচনা করেছেন বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস। হর্ষের সময় ভারতে আসেন হিউ-য়েন-সাং এবং রচনা করে সি-ইউ-কি। এই গ্রন্থ কেবল বৌদ্ধ ধর্ম বা ধর্মের সাথে বিজড়িত বিষয়ে আলোচনা করেনি, রাজা হর্ষ ও তাঁর সমসাময়িক উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস জানার ব্যপারে এই গ্রন্থ খুবই উল্লেখযোগ্য। তবে এই গ্রন্থে রাজা হর্ষের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। চাও জুকুয়া রচিত ঝু-ফাং-ঝি গ্রন্থে সমসাময়িক বন্দর, বাণিজ্য কেন্দ্র এবং ব্যবসা পন্যের উল্লেখ পাওয়া যায়।
আরব লেখকদের রচনা আদি মধ্য যুগের ইতিহাস চর্চায় খুবই কার্যকরী। অজ্ঞাতনামা আরব লেখকের চাচনামা থেকে আরব বণিকদের সিন্ধু বিজয়ের তথ্য পাওয়া যায়। আল বিলাধুবির রচনা একই কারণে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আরব বণিক সুলেমান ৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন। দেবপালের সাম্রাজ্যঃ ঘুরে তিনি রচনা করেন সিলসিলা- আল -তাওয়ারিখ। পাল রাজ্যের অবস্থান এবং প্রতিহার রাজ্যের সঙ্গে পাল রাজাদের বিরোধের কথা এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। বাগদাদের অধিবাসী আল মাসুদি গুজরাট পরিভ্রমণ করে প্রতিহার রাজাদের পরাক্রম ও সাম্রাজ্যের বিশালতার বিবরণ দিয়েছেন। আবু নাসের বিন উদবি রচিত কিতাব- উল- ইয়ামনী থেকে সবুক্তিগীন ও সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়। মামুদ এর জীবনী তারিখ ই মাহমুদী রচনা করেছেন আবুল ফজল বৈহাকি।
প্রাচ্যের প্লিনি আল ইদ্রিসি ছিলেন মরক্কোর আরব অধিবাসী। তাঁর রচিত ভূগোল আল মুস্তাক থেকে সিন্ধুতে আরব শাসন এবং এখানকার বিভিন্ন বন্দর, যেমন- দেবল, মানসুরা, আলোর প্রভৃতি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।
আদি মধ্যযুগের বিখ্যাত আরব পর্যটক হলেন আল-বিরুনী। মামুদের অভিযানের সময় তিনি ভারতে এসেছিলেন। তাঁর রচিত কিতাব উল হিন্দ। তিনি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। রাজনৈতিক কথা বিশেষ নেই এখানে। তবে জ্যোতির্বিদ্যা ,ভূ বিদ্যা, দর্শন ও ধর্ম সম্পর্কে গভীর আলোচনা করেছেন।
সাহিত্যিক উপাদান কখনই ত্রুটিমুক্ত হয় না। লেখকের পক্ষপাতিত্ব, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভাব, জনশ্রুতি নির্ভরতা এবং অনুবাদ বা প্রতিলিপির সময় বিকৃত হওয়ার মত সমস্যা সাহিত্যিক উপাদানে লেগেই থাকে। তবুও আদিমধ্য যুগের ইতিহাস চর্চায় সাহিত্যিক উপাদানের গুরুত্ব অপরিসীম।
Thanks for reading.
Thank you sir.
উত্তরমুছুন