টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের পতন
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে জাপান বহির্বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত হয় এবং দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে। এই ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই জাপানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এক সুদুরপ্রসারী পরিবর্তন ঘটে যায়। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে জাপানে টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। প্রতীকিভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে সম্রাটের উপস্থিতি থাকলেও শোগুনের হাতেই সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল। উনিশ শতকের গোড়া থেকেই শোগুন শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এই শতকের শেষার্ধেই জাপানে শোগুনতন্ত্রের অবসান ঘটে এবং সম্রাটকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়, যা মেইজি পুনঃপ্রতিষ্ঠা নামেও পরিচিত।
শোগুনতন্ত্রের পতনের ব্যাখ্যা বিভিন্ন পন্ডিত বিভিন্নভাবে করেছেন। অনেকেই শকুনতন্ত্রের পতনের পশ্চাদে শিন্টো ধর্মের পুনরুত্থান এবং বিদেশি বিরোধী জাপানি জাতীয়তাবাদকে দায়ী করেছেন। জাপানের বেশিরভাগ মানুষ শিন্টো ধর্ম পালন করত। কিন্তু শোগুন শাসকেরা বৌদ্ধ ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্মে পরিণত করেছিল। বৌদ্ধধর্ম চীন দেশ থেকে জাপানে এসেছিল এবং শকুন শাসকদের উপরে চীনা প্রভাবও ছিল। ১৮ শতকের প্রখ্যাত জাপানি তাত্ত্বিক নোবুনাগা মোটুরি শিন্টো ধর্মের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং তার প্রচারের ফলেই চৈনিক ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবের বিরোধিতা এবং শিন্টো ধর্মের পুনরুত্থানের দাবি জাপানে শোগুন বিরোধী আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তা প্রবল আকার ধারণ করেছিল। আন্দোলনকারীরা সম্রাটের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিল। তাদের স্লোগান ছিল সোন্নো-জো-ই অর্থাৎ Revere the Emperor, expel the foreigners.
অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং সমসাময়িক সংকটজনক পরিস্থিতি টোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। উনিশ শতকের সূচনা থেকে শোগুনতন্ত্রের প্রশাসনিক দক্ষতা হ্রাস পেতে থাকে। শোগুন শাসকেরা সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য অনেকাংশেই ডাইমিও এবং সামুরাইদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এই নির্ভরশীলতাই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। ডায়মিওগণ খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে জঘন্যতম পন্থা অবলম্বন করতেন। কিন্তু শোগুনের পক্ষে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে জাপান বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে সামুরাইদের পেশাগত যোগ্যতা অনেকাংশই হ্রাস পায়। তারা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে শুরু করে, কিন্তু তাদের সে বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংকট দেখা দেয়। অংশত সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় সংকট অংশত দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর ফলে মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিক আকার ধারণ করে। বিশেষ করে চালের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ জাপানিদের প্রবল সমস্যায় ফেলে। এর ফলে ইয়েনারির আমলে বিখ্যাত 'চাউল দাঙ্গা' হয়। সমসাময়িক সংকট নিরসনের চেষ্টা যে শোগুন শাসকগণ করেননি তা নয়, কিন্তু তাদের প্রতিটি পদক্ষেপই ব্যর্থ হয়েছিল। ইয়েযোশীর টেম্পো সংস্কারও ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারেনি।
ই. এইচ. নরম্যান এবং জন হ্যালিডে জাপানের কৃষক বিদ্রোহগুলিকে শোগুনতন্ত্রের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছেন। কৃষকদের উপর মাত্রাতিরিক্ত করের বোঝা এবং তার উপর ডাইমিওদের অত্যাচার ও নির্যাতন কৃষকদের ব্যাপকভাবে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। তার ওপর ১৭-১৮ শতকে চালের মূল্য হ্রাস পাওয়া এবং মুদ্রা অর্থনীতির প্রচলন কৃষকদের সংকটকে আরো বাড়িয়ে তুলেছিল। এর ফলে ১৮-১৯ শতকে একাধিক কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, যা জাপানের সামন্ততন্ত্রের ভিত্তিকে নষ্ট করে দিয়েছিল।
ডাইম্যো এবং সামুরাইদের মধ্যেও বিভিন্ন কারণে শোগুন বিরোধী মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। শহুরে জীবনে অভ্যস্ত ডাইম্যোদের জীবনযাত্রার খরচ এতই বেড়ে গেছিল যে কৃষি সংকট এবং কৃষক বিদ্রোহ জনিত কারণে যখন তাদের আয় কমে গেছিল সেই সময় তারা তাদের আর্থিক দুরবস্থার জন্য শকুনকেই দায়ী করেছিল। অন্যদিকে সামুরাইরা দীর্ঘদিন যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত না থাকার ফলে তাদের আয়ের একটা উৎস বন্ধ হয়ে গেছিল। উপরন্তু শোগুন শাসকেরা তাদের ভাতা হ্রাস করার ফলে তারাও শকুন বিরোধী হয়ে উঠেছিল।
১৮-১৯ শতকে জাপানে একটি নতুন সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল। এই সাংস্কৃতিক জাগরণকে কেন্দ্র করে ইতিহাস চর্চায় জোয়ার এসেছিল। নতুন ইতিহাস চর্চায় শোগুনকে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে দেখানো হয়েছিল এবং দেশের প্রকৃত শাসক হিসেবে জিম্মু তেনোর বংশধর তথা জাপানি সম্রাটকে আইনি শাসক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। এই নতুন ধরনের ইতিহাসচর্চা জাপানিদের মধ্যে সম্রাটের প্রতি আনুগত্য বৃদ্ধি করেছিল এবং শোগুনের প্রতি ঘৃণার জন্ম দিয়েছিল।
প্রখ্যাত জাপানি অর্থনীতিবিদ প্রিন্স মাৎসুকাটা অর্থনৈতিক সংকটকে শোগুনতন্ত্রের পতনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছেন। ১৮ শতকের গোড়ার দিকে একটি মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড এবং ভয়ংকর একটি ভূমিকম্পের ফলে জাপানের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এই সংকট মোকাবিলায় রাজকোষের ওপরে চাপ বাড়ে এবং দেশে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। অবশ্য ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা আসলেও বহির্বাণিজ্যে কোনো উদ্দ্যোগ আসেনি। উনিশ শতকের গোড়ার দিক পর্যন্ত মোটামুটি এই স্থিতিশীলতা বজায় ছিল। কিন্তু এর পর থেকে প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বৃদ্ধি এবং দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর মত বিপর্যয়ের ঘটনা আর্থিক সংকট বাড়িয়ে তোলে। টেম্পো সংস্কার সমুহও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৮৫৪ খ্রীঃ কমোডোর পেরীর অভিযান ও জাপানের বিচ্ছিন্নতার অবসানের পর রপ্তানী বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু রাজকর্মচারীদের অসততা ও দুর্নীতির ফলে সংকটমুক্তির কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।
পেরীর অভিযান এবং জাপানের উন্মূক্তকরণ- এর পর প্রবল শোগুন বিরোধী আন্দোলন দেখা দেয়, যার পিছনে চারটি গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠী কার্যকর ছিল- সাৎসুমা, চোসু, হিজেন ও তোসা। এই আন্দোলনের ফলেই শোগুন তন্ত্রের পতন ঘটে। শোগুনতন্ত্রের পতনের পশ্চাদে যতটা না গন আন্দোলন বা বিদেশি প্রভাব কার্যকর ছিল তার থেকে অনেক বেশী দায়ী ছিল এই ব্যবস্থা অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, পরিবর্তন বিমুখতা এবং পরিশেষে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তের অভাব। তাই শোগুনতন্তের পতনকে 'হত্যা' না বলে 'আত্মহত্যা' বলাই শ্রেয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন