সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সুয়েজ সংকট | The Suez Crisis

সুয়েজ সংকট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি যেসব বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয়ে উঠেছিল তার মধ্যে সুয়েজ খাল সংকট অন্যতম, যা একদিকে দ্বিতীয় আরব ইজরায়েল সংঘর্ষের জন্য দায়ী এবং যাকে কেন্দ্র করে ঠান্ডা লড়াইয়ের রাজনীতি মধ্যপ্রাচ্যেও প্রবেশ করে।

১৯৫৬ খ্রি: মিশরে গামাল আব্দেল নাসের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি হয়ে নাসের একদিকে সমগ্র আরব জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে বদ্ধপরিকর হন, তেমনি অন্যদিকে মিশরকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বেশকিছু সংস্কার ও কর্মসূচি গ্রহণ করেন। মিশরের অভ্যন্তরীণ অবস্থার উন্নয়নের জন্য নাসের কৃষি অর্থনীতি ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বার্থে ১৪০০মিলিয়ন ডলারের আসোয়ান বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। মার্কিন, ব্রিটেন ও ফ্রান্স শুরুতে ওই বাঁধ নির্মাণে মিশরকে ঋণদান করার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরবর্তী সময়ে নাসেরের কমিউনিস্ট সংসর্গ এবং ইজরায়েল বিরোধীতার কারণে তা দিতে অস্বীকার করে।

এই পরিস্থিতিতে নাসের এক বিকল্প পথ অনুসন্ধানে রত হন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে জুলাই নাসের এক ঐতিহাসিক ও সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সুয়েজ খালের জাতীয়করণ এর কথা ঘোষণা করেন। বলা হয়, সুয়েজ খাল মিশরের জাতীয় সম্পদ তাই এই জলপথ থেকে ব্রিটিশ ও ফরাসি কোম্পানিগুলি আর মুনাফা লাভ করতে পারবে না। তবে ওই কোম্পানি গুলির ক্ষতিপূরণ বাজার মূল্য অনুযায়ী মিটিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। আরো বলা হয়, সুয়েজ খাল থেকে অর্জিত রাজস্বের দ্বারা আসোয়ান বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের খরচ চালানো হবে।

নাসেরের এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ইংল্যান্ড। কারণ সুয়েজ খাল কোম্পানির ৮৮% শেয়ার ছিল তার ইংল্যান্ডের। প্রধানমন্ত্রী এন্টনি এডেন প্রতিক্রিয়া হিসাবে তাৎক্ষণিকভাবে নাসেরকে হিটলার ও মুসোলিনির পরবর্তী সংস্করণ বলে অভিহিত করেন। যুক্তরাষ্ট্র নিরব ছিল, তবুও তার সমর্থন ছিল পশ্চিমী শক্তি গুলির দিকে।

ক্ষতিপূরণ পেলেও ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স মিশরের শত্রু ইজরায়েলকে মিশর আক্রমণের প্ররোচনা দিতে থাকে। তিন শক্তির যৌথবাহিনী ২৯ শে অক্টোবর মিশর আক্রমণ করে। আক্রমণ ভয়াবহ আকার নেয়। মিশর সুয়েজ খাল হারাতে বসে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বিশ্বজনমত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইজরায়েলের সাম্রাজ্যবাদী নীতির সমালোচনা করে। যুদ্ধবিরতি না করলে আক্রমনকারী দেশের উপর ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগের হুমকি দেয় সোভিয়েত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখলেও তার সমর্থন পশ্চিমী শক্তিগুলির দিকে ছিল। রাষ্ট্রসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় আক্রমণকারীরা পিছু হটে, মিশর থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে সম্মত হয়। জাতিপুঞ্জের শান্তিরক্ষা বাহিনী ইজরায়েল-মিশর সীমান্তে নিয়োগ করা হয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...