মৌর্য অর্থনীতি | Maurya Economy
মৌর্যরা যে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল তার জন্য দরকার ছিল ব্যাপক হারে সম্পদ সংগ্রহ করা। এজন্য মৌর্য যুগের অর্থনীতির অন্যতম চরিত্র ছিল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। মৌর্য যুগের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির পরিচয় আমরা পাব কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, সমসাময়িক গ্রিক বিবরণী এবং অশোকের অনুশাসনগুলি থেকে।
কৃষি অর্থনীতি
গ্রিক বিবরণী থেকে জানা যায়, মৌর্য যুগের উৎপন্ন ফসলের নানান বৈচিত্র ছিল। প্রধান ফসল ছিল ধান। ধান ছাড়াও গম, জোয়ার, বাজরা এবং আখ চাষের কথা জানা যায়। জনসংখ্যার বেশিরভাগই ছিল কৃষিজীবী। কৃষির উপর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল এক প্রকার উচ্চপদস্থ কর্মচারীর হাতে, যিনি অর্থশাস্ত্র-এ সীতাধ্যক্ষ নামে পরিচিত ছিলেন। সীতা জমি ছিল আসলে রাজার খাসজমি। তবে সীতাধ্যক্ষ কেবল সীতা জমিতেই নয়, সাম্রাজ্যের অন্যান্য জমিতেও উৎপাদনের তদারকি করতেন।
অর্থশাস্ত্রে সীতা জমির উৎপাদনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই প্রকার জমিতে দু'রকম কৃষি শ্রমিক নিয়োগ করা হত; একদল নিজস্ব উপকরণ দিয়ে চাষ করত, আরেকদল কেবল দৈহিক পরিশ্রম দিত। তাই প্রথম দল উৎপাদনের ১/২ অংশ এবং দ্বিতীয় দল ১/৪ বা ১/৫ অংশ পারিশ্রমিক হিসেবে পেত।
অর্থশাস্ত্রের নতুন নতুন জনবসতি গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, যা জনপদনিবেশ নামে পরিচিত। কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য অনাবাদী জমিকে চাষের আওতায় আনার উদ্দেশ্যে এই পদক্ষেপ নেওয়া হত। এর জন্য দেশের ভিতরে জনবহুল এলাকা থেকে অথবা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাইরে থেকে লোক এনে জনপদ বসানোর কথা বলা হয়েছে। কলিঙ্গ জয়ের পর অশোক কলিঙ্গবাসীকে তুলে এনে নতুন জনপদে বসিয়েছিলেন। জনপদের আয়তন এবং জনসংখ্যা কেমন হবে সে বিষয়ে রাষ্ট্র যথেষ্ট সচেতন ছিল। জনপদে দুই প্রকার জমি ছিলঃ করদ ও নিষ্কর। অগ্রহার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ ও রাজকর্মচারীদের নিষ্কর জমি দেওয়া হত। চাষিরা ছিল একরকম ভাড়াটিয়া চাষী। যদি কোনো ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে জমি প্রস্তুত করে তাহলে সেই জমির উপর পূর্ণ মালিকানা সে পেত। চাষবাসে অমনোযোগী কৃষককে রাস্ট্র জমি থেকে সরিয়ে দিতে পারত। কৌটিল্য জনপদনিবেশের জন্য নানারকম কর ছাড় দেওয়ার এবং কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন। তবে তা যেন রাষ্ট্রের পক্ষে অবশ্যই লাভজনক হয়।
কৃষির অচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল জলসেচ। মেগাস্থিনিসের লেখা থেকে এগ্রোনোময় নামক এক প্রকার গ্রামীণ তত্ত্বাবধায়কের নাম পাওয়া যায়, যার অন্যতম কর্তব্য ছিল জলসেচ ব্যবস্থা তদারকি করা। জুনাগড় প্রশস্তি থেকে জানা যায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য জুনাগড়ে বিশাল সুদর্শন হ্রদ খনন করে দিয়েছিলেন। অশোকের আমলে ওই জলাধারটিতে কয়েকটি প্রণালী সংযুক্ত হয়েছিল। ভান্ডারকর বিদিশাতে উৎখনন চালিয়ে একটি সেচ খালের সন্ধান পেয়েছেন। সেচ ব্যবস্থার উপর রাষ্ট্রের পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল বলেই মৌর্য শাসকরা উদকভাগ নামক এক প্রকার সেচকর আদায় করতেন।
জমির মালিকানা কার হাতে ছিল তাই নিয়ে মতপার্থক্য আছে। গ্রিক লেখকদের বিবরণীতে সবরকম জমির উপর পূর্ণ রাজকীয় মালিকানা কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে সীতা জমির উপরে রাজার পূর্ণ মালিকানা ছিল। কিন্তু অন্য জমির উপরে রাজার বিশেষ অধিকার ছিল না। অর্থশাস্ত্রে জমির মালিকানা নিয়ে বিবাদ এবং সেই বিবাদের নিষ্পত্তির জন্য আইন রয়েছে। অর্থাৎ অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী জমির ব্যক্তিগত মালিকানা অসম্ভব নয়। মৌর্য যুগের পরেও জমির ব্যক্তিগত মালিকানার অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে ব্যক্তিগত মালিকানা থাকলেও কৃষির উপর রাষ্ট্রের কড়া নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল একথা অনস্বীকার্য।
কারিগরি উৎপাদন
কৃষিজ উদ্বৃত্তের দরুন আলোচ্য পর্বে পেশাদারী কারিগরদের কার্যকলাপের পথ সুগম হয়েছিল। আরিয়ানের লেখা থেকে জানা যায় যে সব কারিগরি উৎপাদন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পরিচালিত হত এবং কারিগররা রাষ্ট্র থেকে বেতন পেত। কিন্তু স্ট্র্যাবোর লেখা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, জাহাজ নির্মাণ এবং অস্ত্রশস্ত্র নির্মাণ ব্যতীত অন্য সমস্ত কারিগরি উৎপাদন ব্যক্তিগত উদ্যোগের আয়ত্তাধীন ছিল। মেগাস্থিনিস এর লেখায় কারিগরদের উপর তদারকির কথা আমরা জানতে পারি। কৌটিল্য কারিগরি উৎপাদনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। অর্থাৎ মৌর্য যুগে কারিগর উৎপাদনে ব্যক্তিগত উদ্যোগ থাকলেও সেখানে রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকত।
অর্থশাস্ত্র মতে খনি ছিল সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। অর্থশাস্ত্রে ধাতু বিষয়ে তদারকির জন্য অকরাধ্যক্ষ নিয়োগের কথা রয়েছে। তবে যেখানে ধাতু নিষ্কাশনে অধিক মুলধন দরকার হত সেখানে বেসরকারি উদ্যোগকে শর্তসাপেক্ষে স্বাগত জানানো হত। বিভিন্ন ধাতুর কারখানাগুলিও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন থাকত। এই ক্ষেত্রে লোহাধ্যক্ষ, খনাধ্যক্ষ, রূপিক, রূপদর্শক প্রভৃতি তদারক কর্মচারীর কথা জানা যায়। এরা সকলে অকরাধ্যক্ষের অধীনে থেকে কাজ করতেন। কারখানা থেকে উৎপন্ন দ্রব্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় বিক্রি ও সরবরাহের নির্দেশ অর্থশাস্ত্রে রয়েছে।
মৌর্য সাম্রাজ্যের দক্ষিণাংশে সুবর্ণ গিরি নামক প্রাদেশিক শাসনকেন্দ্রের নাম পাওয়া যায়। রেমণ্ড অলচিন দেখিয়েছেন এখান থেকে সোনা পাওয়া যেত বলে এর নাম হয়েছে সুবর্ণগিরি। তিনি আরও দেখেছেন যে কর্নাটকের কাছাকাছি কয়েকটি এলাকায় হিরেও পাওয়া যেত। তাই সুবর্ণগিরির শাসক একজন রাজপুত্রই হতেন।
বস্ত্র শিল্প এবং সূরা শিল্পের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের কথা আমরা পাই, কারণ এই দুই শিল্পের তত্ত্বাবধানের জন্য সূত্রাধ্যক্ষ ও সূরাধ্যক্ষ নামক উচ্চপদস্থ কর্মচারী রাখা ছিল। কৌটিল্য সূতা উৎপাদনে মহিলা শ্রমিক নিয়োগের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। তবে প্রশ্ন জাগে যে সমগ্র ভারত জুড়ে এই দুটি শিল্পের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কিভাবে সম্ভব? সম্ভবত ব্যক্তিগত উদ্যোগের উপর প্রশাসনিক নজরদারি চলত। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্প উৎপাদনে রাষ্ট্র সরাসরি নাক না গলালেও কর চাপিয়ে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন