ঔরঙ্গজেবের ধর্ম নীতি
মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব ব্যক্তিজীবনে একজন ধার্মিক সুন্নি মুসলমান ছিলেন। দিনে পাঁচবার নামাজ থেকে শুরু করে রমজান পালন এবং অন্যান্য যাবতীয় ইসলামিক রীতি রেওয়াজ মেনে চলতেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় জীবনে শাসক হিসাবে তিনি কতটা ধর্মীয় গোঁড়ামি দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন তা বিতর্কের বিষয়। বিতর্কের এক দিকে রয়েছেন পণ্ডিত শ্রী রাম শর্মা, যিনি তাঁর "The Religious Policy of the Mughal Emperors" গ্রন্থে ঔরঙ্গজেবকে একজন হিন্দু বিরোধী গোঁড়া মুসলমান শাসক হিসেবে তুলে ধরেছেন। অন্য দিকে অধ্যাপক আতাহার আলী এবং অন্যান্য আধুনিক ঐতিহাসিকগণ অধ্যাপক শ্রীরাম শর্মার বক্তব্যের খন্ডন করেছেন।ঔরঙ্গজেবের ধর্মনীতি সংক্রান্ত বিতর্কের মুলত তিনটি দিকঃ রাজপুত ও হিন্দুদের দমন; মন্দির ধ্বংস এবং জিজিয়া কর পুনঃ প্রবর্তন।
ইউরোপীয় পর্যটকদের বিবরণীর উপর নির্ভর করে অধ্যাপক শ্রীরাম শর্মা, ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে একাধিক হিন্দু বিদ্বেষমুলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এনেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন ঔরঙ্গজেব শিখদের বিরুদ্ধে ঢালাও গণহত্যার হুকুম দিয়েছিলেন। এই তথ্যের উৎস হিসাবে মাসীর-ই- আলমঙ্গীরি-র (পৃ- ১৪১) উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অধ্যাপক আতাহার আলী উক্ত গ্রন্থ পর্যালোচনায় দেখিয়েছেন ওই গ্রন্থের ওই পাতায় এই ধরনের কোনো মন্তব্য নেই। তিনি আরো দেখিয়েছেন যে তার সময় হিন্দু কর্মচারীর সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু আতাহার আলী দেখিয়েছেন প্রথম ২০ বছরে রাজপুতদের সঙ্গে বিরোধিতার কোনো নজির নেই; বরং রাজপুতরা তার কাছের লোক ছিলেন। তার শাসনে প্রথম ২ বছরে ১৪,১০০ জাঠ পদ এবং নতুন মনসবের ১৯ শতাংশ রাজপুতদের দেওয়া হয়েছিল। জয়সিংহ ও যশবন্ত সিংহ ৭ হাজারী মনসব পেয়েছিলেন, যা আকবরের সময় মানসিংহ এর পর এই প্রথম। তা ছাড়া রাঠোররা যে বিদ্রোহ করেছিল তা ছিল রাজপুতদের অন্তদ্বন্দ্ব এর ফল। ঔরঙ্গজেব দ্রুত রাঠোরদের বিবাদ মিটিয়ে দাক্ষিণাত্য রওনা দিয়েছিলেন। তা ছাড়া অন্যান্য রাজপুত গোষ্ঠী যেমন হাড়া, ভাটি, কাছোয়া-রা ঔরঙ্গজেবের মিত্রই ছিলেন।
ডঃ শর্মা হিন্দু দেবালয় ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন। যদুনাথ সরকারও মন্দির ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন। ঔরঙ্গজেবের মন্দির ধ্বংস সত্য হলেও সার্বিক নীতি ছিল না। কারণ রাঠোররা যখন ইন্দোর সিংহের বদলে স্বর্গীয় রাজা যশোবন্ত সিংহ এর নাবালক পুত্র অজিত সিংকে যোধপুরের টিকা দিলে সেখানকার সমস্ত মন্দির ভেঙে দেয়ার প্রস্তাব দেয় ঔরঙ্গজেব কিন্তু তা নাকচ করে দেন। তাছাড়া তিনি জীবনের বেশিরভাগ সময় দাক্ষিণাত্যে অতিবাহিত করেছেন। কিন্তু সেখানকার কোনো মন্দিরের কোনো রকম ক্ষতি করেননি। যে মন্দির গুলি ভাঙা হয়েছিল সেই গুলি রাজনৈতিক কারণে ভাঙা হয়েছিল। সেই একই কারণে অনেক মসজিদও ভাঙা হয়ে ছিল। শাসকের সার্বভৌম ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করলে কোনো শাসকই সে মন্দির হোক বা মসজিদ কোনো কিছুই ভাঙতে রেয়াত করতেন না।
ঔরঙ্গজেব ১৬৭৯ খ্রিঃ জিজিয়া পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন। জিজিয়াকে অনেকে ধর্মীয় কর রূপে অভিহিত করে ঔরঙ্গজেবের হিন্দু বিদ্বেষের তত্ব খাড়া করেছেন। সতীশ চন্দ্র দেখিয়েছেন জিজিয়া কোনো ধর্মীয় কর নয়। এটি কোরান নির্দেশিত সামরিক কাজের বিনিময় কর। যারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতো না তাদের উপর মাথা পিছু কর চাপানো হত। তাই শিশু, মহিলা ও বয়স্করা এই করের বাইরে ছিল। কোনো অমুসলিম যদি মুঘল সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত থাকে তবে তাকে এই কর দিতে হতো না। তা ছাড়া মুসলমানদের জাকাত (সঞ্চিত সম্পত্তির আড়াই শতাংশ ) দিতে হত, যা অমুসলিমদের দিতে হত না।
পরিশেষে বলা যায় ঔরঙ্গজেব ব্যাক্তি জীবনে ধার্মিক হলেও তার শাসন হিন্দু বিরোধী ছিল বা তার রাজ্য ধর্মরাজ্যে পরিণত হয়েছিল এমন বলা যায় না। তবে আধুনিক অর্থে যাকে সেকুলার রাষ্ট্র বলা হয় সেটাও ছিল না। আসলে ঔরঙ্গজেবের শাসন ছিল স্বৈরাচারী শাসন, প্রজার উপর রাজার প্রভুত্ব মূলক শাসন।
Thank you sir.
উত্তরমুছুন🙏
উত্তরমুছুন