শাসক হিসেবে হুমায়ূনের কর্তৃত্বের আলোচনা কর?
শাসক হিসেবে হুমায়ূন কি কি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল? সেগুলি সমাধানে তিনি কতটা সফল হয়ে ছিলেন?
১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে ২৬ শে ডিসেম্বর বাবরের মৃত্যুর ৪ দিন পর ৩০ শে ডিসেম্বর তার পুত্র হুমায়ূন ২৩ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন। সিংহাসন আরোহনের ৪ দিন বিলম্ব হওয়ায় পশ্চাতে কী কারন ছিল তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে ঐতিহাসিকগণ দেখিয়েছেন যে, বাবরের ভগ্নিপতি মেহদি খাজা সিংহাসনের অন্যতম দাবিদার হয়ে উঠেছিলেন। এই বিবাদের মিটমাট হতে সম্ভবত ৪ দিন বিলম্ব হয়েছিল। যাই হোক সিংহাসন আরোহনের পর হুমায়ূনকে একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল এবং এই সমস্যাগুলির যথার্থ সমাধান করতে তিনি ব্যার্থ হয়েছিলেন। আফগান নেতা শের খাঁ - র সঙ্গে শক্তির পরীক্ষায় পরাস্ত হয়ে তাঁকে ১৫ বছর (পারস্যে) নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। যদিও শের খাঁ- র উত্তরাধিকারিদের পরাজিত করে তিনি পুনর্বার সিংহাসন দখল করতে সক্ষম হন।
হুমায়ুনের সমস্যাসমূহ
বাবর হুমায়ূনের জন্য যে সাম্রাজ্য রেখে যান তা মধ্য এশিয়ার কিছু অংশ থেকে বর্তমান ভারতের পাঞ্জাব, মুলতান, উত্তর প্রদেশ, গোয়ালিয়র, ডোলপুর, বায়ানা এবং চান্দেরি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বাবর শক্তিশালী আফগান সর্দারদের দমন করলেও বিনষ্ট করতে পারেননি। রাজপুতরাও সাময়িকভাবে নিস্ক্রিয় হয়েছিল মাত্র। ইব্রাহিম লোদীর ভ্রাতা মাহমুদ লোদিকে কেন্দ্র করে আফগানরা সংঘবদ্ধ হয়েছিলে। শের খাঁ বাংলা ও বিহারের আফগানদের শক্ত ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলেন। বাংলার নসরৎ শাহ এই সময় আফগানদের পক্ষে ছিলেন। গুজরাটের শাসক বাহাদুর শাহও হুমায়ুনের বিপক্ষ অবস্থান নিয়ে আফগান অভিজাত আলম খাঁ লোদীকে নিজের দরবারে আশ্রয় দিয়ে ছিলেন।
রাজপরিবার ও দরবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। পিতার আদেশ অনুযায়ী হুমায়ুন কনিষ্ঠ ভ্রাত্রাদের মধ্যে সাম্রাজ্য বন্টন করে দিয়েছিলেন। তবুও কামরান, আসকারী ও হিন্দাল-- তিন ভাই-ই সিংহাসনের প্রতি প্রলুব্ধ ছিল। দুই জ্ঞাতিভাই মোহাম্মদ জামাল ও মোহাম্মদ সুলতান একই পথের পথিক ছিলেন। মেহদী খাজা বাবরের প্রধান মন্ত্রী নিজাম উদ্দীন খলিফার চেষ্টায় সিংহাসন দখলের এক ষড়যন্ত্র করেছিল। তুর্কি, উজবেক, পারসিক, আফগান প্রভৃতি জাতি গোষ্ঠীর লোকেদের নিয়ে তৈরি সৈন্যবাহিনী মধ্যে ঐক্য ভেঙে পড়েছিল।
উপরোক্ত সমস্যার আবর্তে হুমায়ূনের মত একজন সৎ, দয়ালু ও ক্ষমাপ্রবণ মানুষের পক্ষে সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা খুবই মুশকিল ছিল। রাজনৈতিক জ্ঞান, দূরদর্শিতা ও অগাধ পাণ্ডিত্যের সত্ত্বেও তার জীবনের নেমে এসে ছিল চরম ভাগ্য বিপর্যয়।
হুমায়ুনের ভাগ্যবিপর্যয়য়
মুঘলদের সৈন সংগ্রহ করার প্রধান জায়গা ছিল মধ্য এশিয়া। পিতার ইচ্ছানুযায়ী ভাইদের মধ্যে সাম্রাজ্য বন্টন করতে গিয়ে তিনি কামরানকে কবুল, কান্দহার ও পশ্চিম পঞ্জাবের শাসনভার দেন। কামরানই ছিল হুমায়ূনের প্রতি সব ভাই দের থেকে বেশি বিদ্বিষ্ট। ফলে মধ্য এশিয়া থেকে হুমায়ূনের পক্ষে সৈন্য সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
হুমায়ুনের প্রথম অভিযান ছিল কালিঞ্জরের বিরুদ্ধে। কালিঞ্জরের নরপতি আফগানদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন বলে হুমায়ূন তার বিরুদ্ধে অভিযান করেছিলেন। কিন্তু পূর্ব দিকে আফগানদের অভ্যুদয়ের সংবাদে তিনি কালিঞ্জরের রাজার কাছ থেকে অর্থের বিনিময় অবরোধ পরিত্যাগ করে আফগানদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। হুমায়ুন যদি কূটনৈতিক বুদ্ধি প্রয়োগ করে কালিঞ্জরকে অধীনতামূলক বন্ধুতে পরিণত করতে পারতেন তাহলে লাভবান হতেন বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে তিনি পূর্ব ভারতের আফগানদের সম্মুখীন হন এবং ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে দদরাহর যুদ্ধে তাদের পরাজিত করেন। অন্যতম আফগান নেতা শের খাঁ বিখ্যাত চুনার দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করলে হুমায়ুন চুনার দুর্গ অবরোধ করেন। ৪ মাস অবরোধের পর গুজরাটের বাহাদুর শাহের আগ্রা অভিযানের সংবাদ পেয়ে শের খাঁ- র মৌখিক প্রতিশ্রুতি পেয়ে (সামন্ত রাজা হওয়ার) অবরোধ ত্যাগ করেন। কেমব্রিজ ঐতিহাসিক জন রিচার্ডসের মতে, শের খাঁকে ধ্বংস না করা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
ইতিমধ্যে ভ্রাতা কামরান লাহোর, মুলতান ও হিসার দখল করে নেয়। স্নেহের বশবর্তী হয়ে তিনি কামরানের এই অধিকার মেনে নেন। এর মধ্যে শের খাঁ এবং বাহাদুর শাহ বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। হুমায়ুন শেষ পর্যন্ত বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। মান্দসোরের যুদ্ধে (১৫৩৫ খ্রি) তিনি বাহাদুর শাহকে পরাজিত করলেন কিন্তু তাঁকে ধ্বংস বা মিত্র কোনোটাই না করে ভ্রাতা আসকরির হতে গুজরাটের দায়িত্ব অর্পণ করে দিল্লি ফিরে আসেন। ফলে কিছুদিন পর আবার বাহাদুর শাহ গুজরাট দখল করে নেন।
১৫৩৭ খ্রি হুমায়ূন শের খাঁ- র বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করে প্রথমে চুনার দুর্গ দখল করেন। সেখানে অহেতুক ৬ মাস সময় নষ্ট করেন; কারন তখন শের খাঁ গৌড় অভিযান করছিলেন। ছয় মাস পর হুমায়ূন যখন গৌড় অধিকার করেন তখন শের খাঁ বিহারে পালিয়ে যান। এখনে ৬ মাস বর্ষা উপভোগ করতে করতে দিন কাটিয়ে দেন। এদিকে শের খাঁ বারাণসী, জৈনপুর ও চুনার দখল করে হুমায়ূনের দিল্লি ফেরার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেন। এর পর চৌসা নামক স্থানে উভয়ের বাহিনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় (১৫৩৯খ্রিঃ) এবং হুমায়ূন সম্পূর্ণ রূপ বিধ্বস্ত হন। একজন ভিস্তিওয়ালার সহযোগিতায় তিনি প্রাণে বাঁচে যান। ১৫৪০ খৃষ্টাব্দে হুমায়ুন আবার শের খাঁর বিরুদ্ধে অভিযান করেন। শের খাঁ পুনঃরায় হুমায়ূনের বাহিনীকে কনৌজের যুদ্ধে হারিয়ে দিল্লি ও আগ্রা দখল করে নেযন। এরপর হুমায়ূন দেশ ত্যাগ করে পারস্যে আশ্রয় নেন।
১৫ বছরের দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনের পর শের শাহে দুর্বল উত্তরাধিকারিদের সময়ে ১৫৫৫ খ্রি হুমায়ূনের প্রত্যাবর্তন ঘটে। বৈরাম খানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সিরহিন্দ (১৫৫৫ খ্রীঃ) ও মাছিওয়াড়ার যুদ্ধে (১৫৫৫ খ্রি) আফগান শক্তিকে পরাজিত করে পুনরায় দিল্লি ও আগ্রা দখল করতে সক্ষম হন। যদিও ১ বছরের মধ্যে তার মৃত্যু হয় এবং মুঘল সাম্রাজ্য নতুন করে বিপদের মধ্যে পড়ে।
Thank you sir.
উত্তরমুছুনThank you🙏sir.
উত্তরমুছুন