আদি মধ্য যুগে কৃষি উৎপাদন ও ভূমি সম্পর্ক
ভারতবর্ষ বরাবরই কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিই এদেশের মানুষের প্রধান জীবিকা প্রাচীনকাল থেকেই। ভারতের মাটি উর্বর; জলবায়ু অনুকূল; এবং এখানে পর্যাপ্ত শ্রমের কখনো অভাব ছিল না। প্রাচীনকাল থেকেই কৃষি উৎপাদনের অগ্রগতিতে কখনো বাধা আসে নি। 600 থেকে 1200 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে সমসাময়িক ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় কৃষির অগ্রগতি অপেক্ষাকৃত দ্রুত হয়েছিল। হিউয়েন সাং সপ্তম শতকে ভারত পরিভ্রমণ করে এক স্বচ্ছল কৃষি ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন।
আলোচ্য পর্বে বহু রকমের কৃষি উৎপাদনের পরিচয় পাওয়া যায়। পদ্মপুরাণ থেকে জানা যায় যে প্রাচীন বাংলায় প্রায় পঞ্চাশ রকমের চাল উৎপাদন হতো। মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন প্রকার শাক সবজি চাষ হতো। উপকূল ভাগের প্রচুর নারকেল উৎপন্ন হতো। দাক্ষিণাত্যে সুপারি ও পানের উৎপাদন ছিল লক্ষণীয়। গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে কার্পাস ও তৈলবীজ ব্যাপকহারে উৎপাদিত হতো। মালাবার অঞ্চল মশলা উৎপাদনে বিখ্যাত ছিল। কাশ্মীরে জাফরান হত। গুজরাটে কর্পূর, হিং, জায়ফল, জৈত্রী চাষের তথ্যও পাওয়া যায়। আলোচ্য পর্বে দুটি কৃষি বিষয়ক গ্রন্থও রচিত হয়েছিল: কৃষিসুক্তি ও কৃষি পরাশর।
আলোচ্য পর্বে কৃষি উৎপাদনের ব্যাপক অগ্রগতির পশ্চাতে অগ্রহার ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলন অন্যতম কারণ ছিল। অগ্রহার ব্যবস্থায় বিশেষ করে পূর্ব ভারতে ব্রাহ্মণ, মন্দির এবং বৌদ্ধ মঠ গুলিকে যে জমি দান করা হয়েছিল তার বেশিরভাগই ছিল অনাবাদী ও পতিত জমি। ভূস্বামী সেই জমির ওপর স্থায়ী স্বত্ব লাভ করে সেগুলিকে আবাদি জমিতে পরিণত করার জন্য কৃষক নিয়োগ করতেন। এর ফলে কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
কৃষির সঙ্গে যুক্ত যন্ত্রপাতির ব্যবহার কৃষির অগ্রগতি কে নিঃসন্দেহে ত্বরান্বিত করে। চহমান বিগ্রহ রাজের হর্ষ লেখতে 'বৃহদলের' বা বড় লাঙলের কথা আছে। জানা যায় যে হাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল কাঠের তৈরি। ঢেঁকির ব্যবহার ছিল । ঢেঁকি ছাড়াও উদু খলের হলে এর ব্যবহার চলত, যার বিবরণ পাওয়া যায় হেমচন্দ্র এর রচনায়।
সেচ ব্যবস্থা কৃষির অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। আলোচ্য পড়বে সেচ ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পাওয়া যাবে কাশ্মীরে। কল ফোনের রচনা থেকে জানা যায়, অবন্তীবর্মার শাসন কালে সূর্য নামক এক ব্যক্তি বিতস্তা নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে বন্যার প্রকোপ থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করেছিলেন। গভীর কূপ খনন করে চাষের জমিতে জল সরবরাহ করার নজির গুজরাট এবং রাজস্থানে পাওয়া যায়। সেচের প্রধান যন্ত্রটি ছিল অরঘট্ট বা ঘটি যন্ত্র। যন্ত্রটিতে একটি চাকার গায়ে অনেকগুলো ঘটি বসানো থাকতো। চক্রটি ঘুরলে ঘটি কূপ বা জলাশয় থেকে জল তুলে একটি নালার মধ্যে ফেলত, যা থেকে সেই জল জমিতে চলে যেত। ইবন বতুতার রচনায় এই ঘটি যন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। ক্ষুদ্রায়তন সেচ প্রকল্প ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বারা সম্ভব হলেও বৃহদায়তন সেচ প্রকল্পের ক্ষেত্রে রাজকীয় উদ্যোগ অপরিহার্য ছিল। এরকমই রাজকীয় উদ্যোগের নজির পাওয়া যাবে পাল এবং চোল রাজাদের এলাকায়। পাল রাজা রামপাল বরেন্দ্র অঞ্চলে একটি বিরাট দীঘি খনন করে দিয়েছিলেন। চোল রাজারাও চোল বারিধি নামে এক জলাশয় খনন করেছিলেন।
আলোচ্য পর্বে কৃষির অগ্রগতির পাশাপাশি ভূমি বন্দোবস্তে নতুন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। অগ্রহার ব্যবস্থা ব্যাপক প্রচলনের ফলে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি বৃদ্ধি পায়। দানগ্রহীতা এই ব্যবস্থায় জমির ওপর স্থায়ী অধিকার পেত। ভূস্বামী যাদের কৃষক হিসেবে নিয়োগ করতেন জমির উপর তাদের মালিকানা থাকত না। ফলে এতদিন যে পতিত জমির উপরে রাজকীয় বা গোষ্ঠী মালিকানা ছিল তা ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিণত হচ্ছে। জমির মালিকানার এই চরিত্র বদলের ফলে কৃষকের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলে অনুমান করা হয়। রামশরণ শর্মা তার সামন্ততন্ত্র তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে, জমির উপর ত্রিস্তরীয় ( রাজা, ভূস্বামী ও কৃষক) ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল কৃষকরা কার্যত ভূমি দাসে পরিণত হয়েছিল। যদিও এই ভূমিদাসে পরিণত হওয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
Sir thank you.
উত্তরমুছুন