সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আদি মধ্য যুগে কৃষি উৎপাদন ও ভূমি সম্পর্ক। Agriculture and Land Relation in 750-1200 C.E.

আদি মধ্য যুগে কৃষি উৎপাদন ও ভূমি সম্পর্ক

ভারতবর্ষ বরাবরই কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষিই এদেশের মানুষের প্রধান জীবিকা প্রাচীনকাল থেকেই। ভারতের মাটি উর্বর; জলবায়ু অনুকূল; এবং এখানে পর্যাপ্ত শ্রমের কখনো অভাব ছিল না। প্রাচীনকাল থেকেই কৃষি উৎপাদনের অগ্রগতিতে কখনো বাধা আসে নি। 600 থেকে 1200 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে সমসাময়িক ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় কৃষির অগ্রগতি অপেক্ষাকৃত দ্রুত হয়েছিল। হিউয়েন সাং সপ্তম শতকে ভারত পরিভ্রমণ করে এক স্বচ্ছল কৃষি ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন। 

আলোচ্য পর্বে বহু রকমের কৃষি উৎপাদনের পরিচয় পাওয়া যায়। পদ্মপুরাণ থেকে জানা যায় যে প্রাচীন বাংলায় প্রায় পঞ্চাশ রকমের চাল উৎপাদন হতো। মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন প্রকার শাক সবজি চাষ হতো। উপকূল ভাগের প্রচুর নারকেল উৎপন্ন হতো। দাক্ষিণাত্যে সুপারি ও পানের উৎপাদন ছিল লক্ষণীয়। গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে কার্পাস ও তৈলবীজ ব্যাপকহারে উৎপাদিত হতো। মালাবার অঞ্চল মশলা উৎপাদনে বিখ্যাত ছিল। কাশ্মীরে জাফরান হত। গুজরাটে কর্পূর, হিং, জায়ফল, জৈত্রী চাষের তথ্যও পাওয়া যায়। আলোচ্য পর্বে দুটি কৃষি বিষয়ক গ্রন্থও রচিত হয়েছিল: কৃষিসুক্তি ও কৃষি পরাশর। 

আলোচ্য পর্বে কৃষি উৎপাদনের ব্যাপক অগ্রগতির পশ্চাতে অগ্রহার ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলন অন্যতম কারণ ছিল। অগ্রহার ব্যবস্থায় বিশেষ করে পূর্ব ভারতে ব্রাহ্মণ, মন্দির এবং বৌদ্ধ মঠ গুলিকে যে জমি দান করা হয়েছিল তার বেশিরভাগই ছিল অনাবাদী ও পতিত জমি। ভূস্বামী সেই জমির ওপর স্থায়ী স্বত্ব লাভ করে সেগুলিকে আবাদি জমিতে পরিণত করার জন্য কৃষক নিয়োগ করতেন। এর ফলে কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

কৃষির সঙ্গে যুক্ত যন্ত্রপাতির ব্যবহার কৃষির অগ্রগতি কে নিঃসন্দেহে ত্বরান্বিত করে। চহমান বিগ্রহ রাজের হর্ষ লেখতে 'বৃহদলের' বা বড় লাঙলের কথা আছে। জানা যায় যে হাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল কাঠের তৈরি। ঢেঁকির ব্যবহার ছিল । ঢেঁকি ছাড়াও উদু খলের হলে এর ব্যবহার চলত, যার বিবরণ পাওয়া যায় হেমচন্দ্র এর রচনায়। 

সেচ ব্যবস্থা কৃষির অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। আলোচ্য পড়বে সেচ ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পাওয়া যাবে কাশ্মীরে। কল ফোনের রচনা থেকে জানা যায়, অবন্তীবর্মার শাসন কালে সূর্য নামক এক ব্যক্তি বিতস্তা নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে বন্যার প্রকোপ থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করেছিলেন। গভীর কূপ খনন করে চাষের জমিতে জল সরবরাহ করার নজির গুজরাট এবং রাজস্থানে পাওয়া যায়। সেচের প্রধান যন্ত্রটি ছিল অরঘট্ট বা ঘটি যন্ত্র। যন্ত্রটিতে একটি চাকার গায়ে অনেকগুলো ঘটি বসানো থাকতো। চক্রটি ঘুরলে ঘটি কূপ বা জলাশয় থেকে জল তুলে একটি নালার মধ্যে ফেলত, যা থেকে সেই জল জমিতে চলে যেত। ইবন বতুতার রচনায় এই ঘটি যন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। ক্ষুদ্রায়তন সেচ প্রকল্প ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দ্বারা সম্ভব হলেও বৃহদায়তন সেচ প্রকল্পের ক্ষেত্রে রাজকীয় উদ্যোগ অপরিহার্য ছিল। এরকমই রাজকীয় উদ্যোগের নজির পাওয়া যাবে পাল এবং চোল রাজাদের এলাকায়। পাল রাজা রামপাল বরেন্দ্র অঞ্চলে একটি বিরাট দীঘি খনন করে দিয়েছিলেন। চোল রাজারাও চোল বারিধি নামে এক জলাশয় খনন করেছিলেন।

আলোচ্য পর্বে কৃষির অগ্রগতির পাশাপাশি ভূমি বন্দোবস্তে নতুন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। অগ্রহার ব্যবস্থা ব্যাপক প্রচলনের ফলে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমি বৃদ্ধি পায়। দানগ্রহীতা এই ব্যবস্থায় জমির ওপর স্থায়ী অধিকার পেত। ভূস্বামী যাদের কৃষক হিসেবে নিয়োগ করতেন জমির উপর তাদের মালিকানা থাকত না। ফলে এতদিন যে পতিত জমির উপরে রাজকীয় বা গোষ্ঠী মালিকানা ছিল তা ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিণত হচ্ছে। জমির মালিকানার এই চরিত্র বদলের ফলে কৃষকের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বলে অনুমান করা হয়। রামশরণ শর্মা তার সামন্ততন্ত্র তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে, জমির উপর ত্রিস্তরীয় ( রাজা, ভূস্বামী ও কৃষক) ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল কৃষকরা কার্যত ভূমি দাসে পরিণত হয়েছিল। যদিও এই ভূমিদাসে পরিণত হওয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক