সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইন্দো-গ্রীক | Indo-greeks

 ইন্দো-গ্রীক

মৌর্য শাসনের একেবারে শেষ দিকে পুষ্যমিত্রর রাজত্বকালে যবন বা গ্রিক রাজাদের দ্বারা সাকেত ও মধ্যমিকা জয়ের কথা আমরা জানতে পারি। এই গ্রিক শাসকগণ ছিলেন গ্রিসের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। আলেকজান্ডারের আক্রমণের সময়  আগত বহু গ্রীক উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাসের নেতৃত্বে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই সাম্রাজ্য সেলুকিড সাম্রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। সেলুকিড সাম্রাজ্যের মূল কেন্দ্র ছিল সিরিয়া। ব্যাকট্রিয়া এবং পার্থীয়া ছিল এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত দুটি স্যাট্র্যাপি বা প্রদেশ। ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাগ অ্যান্টিওকাস-এর রাজত্বকালে উক্ত দু'টি প্রদেশ বিদ্রোহ করে। ব্যাকট্রিয়াতে এই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন ডায়োডোটাস। অবশেষে ওই শতকের শেষ দিকে সেলুকিড শাসক তৃতীয় অ্যান্টিওকাস ব্যাকট্রিয়া ও পার্থীয়ার স্বাধীনতা স্বীকার করে নেন। এইভাবে ব্যাকট্রিয় গ্রিক শাসনের সূচনা হয়। ব্যাকট্রিয় শাখার গ্রিক শাসকগন ব্যাকট্রিয়া হাতছাড়া ( শকদের হাতে ) হওয়ার পর ভারতের উত্তর পশ্চিম দিকের বেশ কিছু এলাকার ওপরে শাসন কায়েম করেছিলেন বলে এদের ইন্দো-গ্রিক শাসকও বলা হয়।


প্রথম ডায়োডোটাস ও দ্বিতীয় ডায়োডোটাস এর পরবর্তী শাসক ছিলেন ইউথাইডেমাস (আনুমানিক খৃ:পূ: ২১২-১৯০)। তার রাজত্বকালে অথবা তার পুত্র ডেমেট্রিয়াসের রাজত্বকালে ব্যাকট্রিয় গ্রিকগণ উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশে অভিযান শুরু করেন। এই অভিযানের ধারা সম্ভবত অব্যাহত ছিল পরবর্তী ইন্দো-গ্রিক শাসক অ্যাপোলোডোটাস, প্যান্টালিওন, আগাথোক্লেশের আমলে। উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাংশের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার দরুন ইন্দো-গ্রিক শাসকগন তাদের মুদ্রায় ভারতীয় লিপি খরোষ্ঠী ও ব্রাহ্মী ব্যবহার করেছিলেন এবং ভারতীয় দেবদেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ করেছিলেন। উত্তর-পশ্চিম এলাকা থেকে রাজস্থানের মধ্যমিকা, গাঙ্গেয় উপত্যাকার সাকেত, পাঞ্চাল এবং সম্ভবত পাটলিপুত্র পর্যন্ত অভিযান করতে এইসব ব্যাকট্রিয় গ্রিক রাজারা সফল হয়েছিলেন।

ইতিমধ্যে ব্যাকট্রিয় গ্রিকদের মধ্যে অন্তরবিরোধ প্রকাশ্যে আসে। জাস্টিনের লেখা থেকে জানা যায় ইউক্রেটাইডস নামে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী সেনাপতি ডেমেট্রিয়াসকে পরাজিত করে ব্যাকট্রিয়া দখল করেছিলেন এবং নিজেকে ব্যাকট্রিয়া শাসক হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। যদিও কিছুদিন পরেই ব্যাকট্রিয়া শক শাসকদের অধীনে চলে যায় এবং ইউক্রেটাইডস বংশীয়রা ব্যাকট্রিয়া থেকে বিতাড়িত হন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ব্যাকট্রিয় গ্রিকদের পরস্পর বিবাদমান এই দুই শাখার শাসকগণ ভারতের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং এরাই প্রকৃতপক্ষে ইন্দো-গ্রিক শাসক।

ইন্দো-গ্রিক শাসক দের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মিনান্দার যিনি পালি গ্রন্থে মিলিন্দ নামেও পরিচিত। তিনি কোন শাখার ইন্দো-গ্রিক শাসক তা স্পষ্ট নয়। তার শাসনকাল সম্পর্কেও কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্ব আছে পণ্ডিতদের মধ্যে। দীনেশ চন্দ্র সরকার মনে করেন তার শাসনকাল খ্রিস্টপূর্ব ১১৫ থেকে ১৯০ অব্দের মধ্যে। অন্যদিকে এ. কে. মজুমদার মনে করেন তিনি শাসন করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ১৪০ থেকে ১৩০ পর্যন্ত। মিনান্দার নিঃসন্দেহে আফগানিস্তানের কিছু অংশ এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত শাসন করেছিলেন। হয়তো পূর্ব ও দক্ষিণ এরাকোশিয়ায় (কান্দাহার) তার নিয়ন্ত্রণ কিছুটা বজায় ছিল। পুস্কলাবতী ও তক্ষশীলা এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ নগর সহ গান্ধারেও তিনি শাসন করেছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল খুব সম্ভবত সাকল বা শিয়ালকোট। এ. কে. মজুমদার মনে করেন মিনান্দার-ই মথুরা ও পাঞ্চালের সঙ্গে মিত্রতাবদ্ধ হয়ে পাটলিপুত্র অভিযান করেছিলেন। আরো জানা যায় যে তিনি বিপাশা নদী অতিক্রম করে রাজ্যবিস্তার করেছিলেন এবং তিনি তার অনুগত রাজাদের সাহায্যে শাসন করতেন। সুতরাং এ কথা অনস্বীকার্য যে ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে মিনান্দার এর রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছিল।

মিনান্দার এর আমলে ইন্দো-গ্রিক শাসকদের  ক্ষমতা সর্বোচ্চ শিখরে উঠলেও তাঁর মৃত্যুর ( আনুমানিক ১৩০ খ্রীঃ পূঃ) পর গ্রিক শাসনের পতন ত্বরান্বিত হয়। এর পিছনে গ্রিকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংঘাত অন্যতম কারণ ছিল। মিনান্দার এর পরবর্তী ইন্দো-গ্রিক শাসক ছিলেন প্রথম স্ট্রাটো, যিনি প্রথম দিকে তাঁর নাবালকত্ব-এর দরুন তাঁর মাতা অ্যাগাথোক্লিয়ারের সঙ্গে যুগ্মভাবে শাসন করেছিলেন এবং পরে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন। এ. কে. মজুমদার মনে করেন প্রথম স্ট্রাটো সম্ভবত তাঁর ভাই অ্যাপোলোডোটাস কর্তৃক উৎখাত হন এবং খ্রীঃ পূঃ ৯৫ অব্দের পর পৌত্র দ্বিতীয় স্ট্রাটোর সঙ্গে যৌথভাবে রাজত্ব করেন। যাইহোক অ্যাপোলোডোটাসই ছিলেন মিনান্দারের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ইন্দো-গ্রীক শাসক। তাঁর শাসন কপিশা, গান্ধার, সিন্ধু ও বারুগাজার উপর বজায় ছিল।

ইন্দো গ্রিক দের মধ্যে শেষ উল্লেখযোগ্য শাসক হলেন অ্যান্টিয়ালকিডাস। তাঁর জারি করা মুদ্রা এবং ভূপালের বেসনগরে প্রাপ্ত একটি লেখ থেকে অনুমান করা হয় যে তাঁর প্রেরিত দূত বেসনগরের রাজার দরবারে প্রেরিত হয়েছিলেন এবং ভগবান বিষ্ণুর সম্মানার্থে বেসনগর গরুড় স্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। তক্ষশীলার ওপর অ্যান্টিয়ালকিডাসের  তার শাসন বজায় ছিল। মধ্য ভারতের শাসকদের সাথেও তাদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। 

অ্যান্টিয়ালকিডাসের পরবর্তী ইন্দো-গ্রীক শাসকগন শকদের রাজত্বকাল মুলত শকদের সাথে দ্বন্দের পর্ব। শকরা ধীরে ধীরে গ্রীক শাসিত এলাকাগুলি দখল করতে থাকে এবং এভাবেই ইন্দো-গ্রীকরা অস্তমিত হয়। হারমেয়স ছিলেন শেষ ইন্দো-গ্রীক শাসক, যিনি কাবুল উপত্যকায় শাসন করেছিলেন এবং কুজুল কদফিসেসের সমসাময়িক ছিলেন। যাই হোক ভারতবর্ষের ইতিহাসে ইন্দো-গ্রীক শাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষত উওর-পশ্চিম ও পশ্চিম ভারতের উপর যে গ্রীক প্রভাব আমরা দেখতে পাই, যেমন গান্ধার শিল্পের উপর গ্রীক প্রভাব, তা ইন্দো-গ্রীক শাসনের জন্যই। 
 



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ