সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আদি মধ্যযুগের সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল কি ?

Please visit our Homepage and Subscribe us.

 কাল মার্কস মানব সভ্যতার বিবর্তনকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। তাঁর মতে, আদিম সাম্যবাদের অবসানের পর দাস ব্যবস্থার সূচনা হয়। এরপর আসে সামন্ততন্ত্রের যুগ। পুঁজিবাদের উত্থান এর মধ্যে দিয়ে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটে। ইউরোপে অষ্টম থেকে 14 শতক পর্যন্ত সময়কালকে সামন্ততন্ত্রের যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সামন্ততন্ত্র হলো এমনই এক ভূমি নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা যেখানে শিল্প ,বাণিজ্য এবং মুদ্রা অর্থনীতি অবহেলিত হয় এবং স্বয়ং সম্পূর্ণ কৃষি অর্থনীতির গড়ে ওঠে।

ভারতীয় লেখকদের মধ্যে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম প্রাচীন ভারতের সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশ এর কথা উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীকালে ডিডি কোসাম্বি তার 'এন ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য স্টাডি অফ দ্যা ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি' গ্রন্থে বলেছেন ভারতে দু'ভাবে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল- 'উঁচু তলা থেকে সামন্ততন্ত্র' ও 'নিচু তলা থেকে সামন্ততন্ত্র'। অগ্রহার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ- মন্দির -দেবালয়, সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের নিষ্কর ভুসম্পত্তি দেওয়া হতো। এইভাবে উপর তলা থেকে শাসন ও রাজনীতিতে বিকেন্দ্রীকরণের সূচনা হয়েছিল। গরীব ও ক্ষুদ্র চাষীদের অসহায়তার সুযোগে সম্পন্ন চাষিরা সেই জমি কিনে নিয়ে ভূস্বামী হয়ে যেত। এইভাবে নিচতলা থেকে সামন্ততন্ত্র গড়ে ওঠে।

রামশরণ শর্মা তার 'ইন্ডিয়ান ফিউডালিজম' গ্রন্থে দেখিয়েছেন গুপ্তযুগে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিকাশের কয়েকটি দিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে সামন্ততন্ত্রের অভিমুখী করেছিল। অগ্রহার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণ ও ধর্মস্থানকে নিষ্কর ভূমিদান করার ফলে রাজকীয় ও গোষ্ঠী মালিকানা হ্রাস পায় ও ব্যক্তি মালিকানার প্রসার ঘটে। দান গ্রহীতা ওই জমিতে কেবল রাজস্ব আদায় নয়, প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব গুলোও পেয়ে গেছিল। যোদ্ধাদেরও গ্রামীণ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সমকালীন স্মৃতিশাস্ত্র গুলিতে ভূমিব্যবস্থায় তিনটি স্তরের কথা জানা যায়-- রাজা, ভূস্বামী ও কৃষক। সুতরাং অগ্রহার ব্যবস্থার ফলে ত্রিস্তরীয় ভূমি ব্যবস্থার সূচনা হয় যা সামন্ততন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

শর্মা আরো দেখিয়েছেন যে এই নতুন ব্যবস্থায় কৃষকরা জমির মালিকানা থেকে বঞ্চিত শ্রম দানে বাধ্য কৃষি শ্রমিকে পরিণত হয়, যা ভূমি দাস এর সঙ্গে তুলনীয়। যেখানে কৃষকদেরকে বোঝাতে আগে গহপতি , কুটুমবি প্রভৃতি শব্দগুলো ব্যবহার করা হত, সেখানে আশ্রিত হালিক, বদ্ধহল প্রভৃতি শব্দগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে। বি এন এস যাদব এই 'আশ্রিত হালিক' শব্দের ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে, কৃষককে জমিতে আবদ্ধ থাকতেই হত। ডি ডি কোসাম্বি দেখিয়েছেন কৃষকরা অনেক ক্ষেত্রে জমি ছেড়ে পালিয়ে যেত। বেগার হিসেবে বেট্টি বা বিষ্টি আদায় করা হত। মহীপালের আমলে কৈবর্ত বিদ্রোহকে শর্মা ও যাদব কৃষক বিদ্রোহ হিসেবেই ব্যাখ্যা করেছেন।

শর্মা আরো দেখিয়েছেন যে, কৃষির উপর জোর দিতে গিয়ে শিল্প ও বাণিজ্যের অবনতি ঘটে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হ্রাস পায়। স্বনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির প্রতিষ্ঠার ফলে আঞ্চলিক প্রয়োজনেই পণ্য উৎপাদন হতে থাকে। শিল্প বাণিজ্য হ্রাস পাওয়ার ফলে মুদ্রা অর্থনীতিতে রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং নগর গুলির পতন ঘটে। শ্রাবস্তী, কপিলাবস্তু , রামগ্রাম , কুশিনগর ও বৈশালীর মত বিখ্যাত নগরগুলি পতনের মুখে পড়ে। যেকটা নগর টিকে ছিল তা কেবল রাজনৈতিক , প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং তীর্থক্ষেত্র হিসেবে।

শর্মা ও যাদবের সামন্ততন্ত্র তত্ত্ব নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে অগ্রহার ব্যবস্থায় দানগ্রহীতা যে নিষ্কর জমি পেতেন তাতে রাজার আর্থিক বিশেষ ক্ষতি হতো না, কারণ ভূস্বামীর স্বেচ্ছাদানে অনেকটা পুষিয়ে যেত এবং 'করশাসন' জারি করে রাজা অগ্রহার এলাকা থেকে কর আদায় করতে পারতেন। হরবনস মুখিয়া দেখিয়েছেন, কৃষি উৎপাদনের উপকরণ গুলির উপর ভূস্বামীর নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রমাণ নেই, এমনকি চুক্তি ব্যবস্থারও কোনো প্রমাণ নেই। তাই সামন্ততন্ত্র যে গড়ে উঠেছিল-- এ কথা বলা যাবে না।

শর্মার বাণিজ্যের অবক্ষয় তত্ত্বের সমালোচনা করেছেন রণবীর চক্রবর্তী। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকেন্দ্র হট্ট, মন্ডপিকা, পেণ্টা, সন্থে, নগরম এর উপস্থিতির কথা তিনি প্রমাণ করেছেন। আরও দেখিয়েছেন যে রোম ভারত বাণিজ্যের অবনতি হলেও চীন ও মিশরের সাথে বহিবাণিজ্য চলত। ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় ও চম্পক লক্ষ্মী যথাক্রমে দক্ষিণ ও উত্তর ভারতে সজীব নগরায়নের চিত্র তুলে ধরেছেন। ব্রতীন্দ্রনাথ মুখার্জী দেখিয়েছেন কড়ি, কপর্দক, চূর্ণী প্রভৃতি বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

সুতরাং আদি মধ্য যুগে ইউরোপীয় মডেলের সামন্ততন্ত্র গড়ে উঠেছিল একথা বলা যাবে না। তবে মধ্যস্বত্ব ভোগী নির্ভর ভুমিবিবস্থার যে বিকাশ ঘটেছিল এবং কৃষকের অবস্থার অবনতি ঘটেছিল তাতে সন্দেহ নেই।

Thanks for reading.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল তা জনজীবনে তীব্রভ

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগার:-   কোনো ব্যাক্তিগত বা অলাভজনক