সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

Dirozio | Young Bengal | ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ আন্দোলন

Please visit our Homepage and Subscribe us.

Dirozio | Young Bengal | ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ আন্দোলন


অধ্যাপক অমলেশ ত্রিপাঠী তার "ইতালীয় রেনেসাঁ ও  বাঙালির সংস্কৃতি" গ্রন্থে লিখেছেন, যেকোনো উপনিবেশিক দেশের নবজাগরণে দুটি প্রক্রিয়া সচল থাকে-- একটি শক্তি বাইরে থেকে এসে ঐতিহ্যবাহী সমাজের ওপর আঘাত হানে, অপরটি হল ভিতরের শক্তি, যা ভেতর থেকে দরজা খুলে দিয়ে পরিবর্তনকে আহ্বান করে। হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ও তার ছাত্রগোষ্ঠী 'নব্যবঙ্গ' ছিল এই ভিতরে শক্তি, যারা উনিশ শতকীয় বাংলায় ভেতর থেকে দরজা খুলে দিয়ে নবজাগরণের পথ প্রশস্ত করেছিল।




জন্মসূত্রে ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) ছিলেন ইউরেশিয়ান, পিতা পর্তুগিজ, মাতা ভারতীয়। পশ্চিমী সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ ও ফরাসি বিপ্লব প্রসূত চিন্তাভাবনার ব্যাপক প্রভাব ছিল তার ওপর। অল্প বয়সেই তিনি একজন আদর্শবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী, আধুনিক মানুষের হয়ে উঠেছিলেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির মধ্য দিয়ে তিনি অল্পবয়সেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।


 ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৮২৬-২৭) মাত্র ১৭ বছর বয়সে হিন্দু কলেজের ইতিহাস ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন। অতি দ্রুত তিনি কলেজে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ডিরোজিওর জীবনীকার এডওয়ার্ডস জানিয়েছেন যে, ছাত্রদের উপর আর কোনও শিক্ষকের এমন প্রভাব ছিল না। 'রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ' গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, চুম্বকের মত তিনি অপরাপর বিভাগের ছাত্রদেরও আকর্ষণ করতেন। শুধু কলেজ এর মধ্যেই নয় বাইরে ও তিনি ছাত্রদের মনন ও চিন্তার উন্নতি ঘটানোর কাজ চালিয়ে যেতেন। ডিরোজিওর অনুগামীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি, মহেশচন্দ্র ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রাধানাথ শিকদার, রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী প্রমুখ। এঁরা ইয়ং বেঙ্গল বা নব্যবঙ্গ নামে পরিচিত হয়েছিলেন।


ডিরোজিও তার ছাত্রদের নতুন চিন্তার খোরাক যোগাতেন। একদিক থেকে তিনি যেমন প্রাচীন ইতিহাসের ঘটনাবলী উল্লেখ করে ছাত্রদের নীতিবোধ দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের আদর্শকে জাগ্রত করতেন, অন্যদিকে পশ্চিমী আধুনিক যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদী আদর্শের প্রতি ছাত্রদের অনুরক্ত করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে, ভারতের এক গৌরবময় অতীত ছিল, যা এখন ম্রিয়মাণ। এই অবক্ষয় থেকে ভারতীয় সমাজকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনা। তিনি তাঁর ছাত্রদের সহযোগিতায় অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন (১৮২৮-২৯) নামে একটি ডিবেটিং সোসাইটিও গড়ে তোলেন।


ডিরোজিওর অনুগামীরা বিশ্বাস করতেন যে, সংস্কার এবং উদারবাদ কখনই এক ছাদের তলায় থাকতে পারেনা। তারা হিন্দু ধর্মের জাতপাত ব্যবস্থাকে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন। ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের তারা চোর ও ভন্ড বলে অভিহিত করতেন। রামমোহন রায় ও তার অনুগামীদের তারা 'আধা উদারপন্থী' বলতেন। তার ছাত্ররা তাদের মতামতকে সাধারণের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পার্থেনন নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন, যেখানে তারা গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধ জুলাই বিপ্লব প্রভৃতির মত ঘটনাবলীর সমর্থনে এবং হিন্দু কুপ্রথাগুলির বিরুদ্ধে লিখতেন। শেষপর্যন্ত প্রাচ্যবাদীদের প্রবল বিরোধিতা এই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। সংবাদ প্রভাকর বা সমাচার চন্দ্রিকার মত পত্রিকাগুলি ডিরোজিয়ানদের বিরুদ্ধে লিখতে থাকেন এবং প্রচার করা হয় যে, ডিরোজিওর প্রভাবে হিন্দুধর্ম বিপন্ন হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের চাপে ১৮৩১ সালে ডিরোজিও পদত্যাগ করেন এবং কয়েক মাস পরে মাত্র ২২ বছর বয়সে কলেরা রোগে মারা যান।


ডিরোজিওর মৃত্যুর পর তার অনুগামীরা তাদের কর্মসূচিকে চালিয়ে যান। ১৮৩১ সালে নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী ইংরেজিতে 'Enquirer' এবং বাংলায় 'জ্ঞানান্বেষণ' নামে দুটি পত্রিকা বের করেন। পত্র-পত্রিকায় তারা নারী শিক্ষা ও নারী মুক্তি স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকা বহুবিবাহ করেছেন এমন একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। বাল্যবিবাহ বহুবিবাহ প্রভৃতির বিরুদ্ধে লেখালেখি করা হয়েছিল। কাশিপ্রসাদ ঘোষ বিধবা বিবাহের পক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রচলন এর লড়াইয়ে রাধানাথ শিকদার পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন। পাশ্চাত্যের অনুগমন করলেও বাংলা ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান শিক্ষার কথা জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল এবং অনেকেই ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন কে সমালোচনা করেছিলেন, যেমন: রসিককৃষ্ণ মল্লিক। তবে তা সংখ্যায় কমই।


ডিরোজিওর মৃত্যুর পর তার অনুগামীদের ভিতরে নাস্তিক্যবাদ থেকে সরে আসার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। অনেকেই সনাতন ধর্মে ফেরত আসেন, যেমন: দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়। অনেকেই আবার খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। মহেশচন্দ্রঘোষ, কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি, আনন্দচন্দ্র মজুমদার প্রমুখরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।


ডিরোজিয়ানরা সমাজে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হয়েছিল। বরং তাদের বিরুদ্ধে হিন্দু ঐতিহ্য বিরোধীতা ও দেশবিরোধীতার অভিযোগ উঠেছিল। ডিরোজিয়ানদের হৈ হট্টগোল এবং প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ মাংস ও পানীয় গ্রহণ রক্ষণশীল সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে ছিল। তাই মানুষ তাদের থেকে দূরে সরে গেছিল। দ্বিতীয়তঃ দু'একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণমূলক দিকটি এড়িয়ে গেছেন। অবশ্য এই দুর্বলতা কেবল  ডিরোজিয়ানদের নয়, সমগ্র উনিশ শতকীয় নবজাগরণেরই দুর্বলতা। তৃতীয়তঃ কৃষ্টদাস পাল লিখেছেন, "বড় বড় কথা বলা এবং বাস্তবে কিছু না করা" এই ছিল তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তারা কোনো ধারাবাহিক কর্মসূচী গ্রহণ করতে পারেননি। কেবল তত্ত্বের কচকচানি দিয়ে অন্তত ভারতীয় সমাজকে পাল্টে দেওয়া যায় না। তাছাড়া ডিরোজিওর মৃত্যুর পর অনেকেই তাদের পূর্ব অবস্থান থেকে সরে গেছিলেন। ফলে দ্রুতই মানুষের মন থেকে তাদের আদর্শগুলি মুছে যেতে থাকে।


সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তারা যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তার গুরুত্ব কম নয়। তারাই প্রথম নিয়ে এলেন নির্ভীক যুক্তিবাদ পশ্চিম বিজ্ঞানের প্রতি আনুগত্য। ঐতিহ্য ও পুনর্জাগরণবাদের ধাক্কায় তা অনেকটা স্তিমিত হলেও একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। সেই প্রভাব আজও রয়ে গেছে।



 Thanks for reading.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...