সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

16-17 শতকীয় বিজ্ঞান বিপ্লবে বিজ্ঞান একাডেমির ভূমিকা

Please visit our Homepage and Subscribe us.

16-17 শতকীয় বিজ্ঞান বিপ্লবে বিজ্ঞান একাডেমির ভূমিকা

ইউরোপে বিজ্ঞান বিপ্লবে একাডেমিক গুলির গুরুত্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা পারস্পরিক ভাব বিনিময় এবং নিজের আবিষ্কার কে অন্যদের সামনে পেশ করে তার মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকেন। প্রথমদিকে এই প্রচেষ্টা অল্পসংখ্যক আগ্রহীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। ক্রমশ বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করেন যে, বিজ্ঞান চর্চার ব্যবহারিক দিক বিস্তৃত করা এবং আবিষ্কারগুলির স্বীকৃতি পাওয়া খুবই প্রয়োজন। এই তাগিদ থেকেই জন্ম নেয় একাডেমী জাতীয় বিজ্ঞান সভাগুলি।

একাডেমি জাতীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের সূত্রপাত হয় রোমে। 1600 খ্রিস্টাব্দে রোমে Accademia dei Lincei প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্লোরেন্সে গড়ে ওঠে Cimento (1651)। 1660 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে গড়ে ওঠে Royal Society। 1666 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে গড়ে ওঠে Academy Royal de Scoiences. ইতালিতে গড়ে ওঠে Accademia Delcimento.

ষোড়শ শতকের একাডেমি হল আজকের বিজ্ঞানীদের গবেষণাগার। একাডেমি গুলো আসলে ছিল বৈজ্ঞানিকদের একটি মিলনক্ষেত্র, যেখানে বিজ্ঞানীরা মিলিত হতেন এবং তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পর্কে পরস্পরকে জানাতেন। সুতরাং একাডেমিগুলি এটা প্রমাণ করেছিল যে, সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জ্ঞানসাধনা করা দার্শনিকের পক্ষে সম্ভব হলেও বিজ্ঞানীর পক্ষে সম্ভব নয়। বিজ্ঞান সাধনায় যৌথ প্রয়াসের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা বুঝিয়ে দিয়েছিল একাডেমিগুলি। একাডেমিক গুলিতে নির্দিষ্ট নিয়মকানুন ছিল, যেগুলি সমস্ত সদস্যদের মেনে চলতে হত। একাডেমিগুলি সচারাচর রক্ষণশীল সমাজের সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে চলত। সামাজিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান চেতনার প্রসারের  উদ্দেশ্যে একাডেমিগুলি বক্তৃতার আয়োজন করত। অনেক ক্ষেত্রে একাডেমী গুলি সরকারি অনুগ্রহ হয়ে যেত। যেমন প্যারিসের একাডেমি সরকারি অর্থানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

বিজ্ঞানী রবার্ট বয়েল, উইলিয়াম পেটি এবং ক্রিস্টোফার রেন এর উদ্যোগে লন্ডনে প্রায় 40 জন বিজ্ঞান সাধক যে সংগঠনের জন্ম দেন, 1662 খ্রিস্টাব্দে রাজকীয় চার্টার পাওয়ার পর তা-ই পরিচয় লাভ করে Royal Society নামে। যদিও এই সংগঠন তৈরির বীজ নিহিত ছিল জন উইলকিন্স, তার সহযোগী ডক্টর ওয়ালিশ এবং জার্মান শরণার্থী বিজ্ঞানী থিওডোর হাক এর সাপ্তাহিক আলোচনার উদ্যোগের মধ্যে। Royal Societyর  ফেলোরা  বৈজ্ঞানিক গবেষণার ব্যয় ভার নিজেরাই বহন করতেন। সোসাইটির মুখপত্র ছিল Philosophical Transactions. সোসাইটিতে ধর্মতত্ত্ব ও রাজনীতির কোন স্থান ছিল না। প্রাকৃতিক বস্তুসমূহ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি, বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের ব্যবহারিক প্রয়োগ বিষয়ে সকলকে অবহিত করা, যন্ত্র প্রক্রিয়া এবং ইঞ্জিনের মতন বিষয়ে উন্নতি ঘটানো এবং যতদুর সম্ভব সহজ-সরল ভাষায় গবেষণার বিষয়বস্তু আলোচনা ছিল সোসাইটির ঘোষিত লক্ষ্য। রয়েল সোসাইটির ফেলো হতে গেলে বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে নিজস্ব, মৌলিক এবং উল্লেখযোগ্য অবদান থাকা আবশ্যক ছিল। সোসাইটির প্রতি অধিবেশনে কমপক্ষে তিনটি বিষয়ের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা মূলক আলোচনা করা ছিল সদস্যদের লক্ষ্য।

ফ্রান্সে বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান সূত্রপাত হয়েছিল সরকারি সহযোগিতায় ফরাসি অর্থমন্ত্রী কোলবের এর  উদ্যোগে গড়ে ওঠে Academy Royal de Scoiences.  সূচনাপর্বে এই একাডেমি উৎপাদনশিল্পের উন্নতি ও বিকাশ ঘটানোতেই বেশি আগ্রহী ছিল। তবে কালক্রমে এই প্রতিষ্ঠান বহু বিচিত্র পেশার সঙ্গে যুক্ত সাবেকী প্রয়োগ ও কৃৎকৌশল বিজ্ঞানসম্মত করে তোলে।

টেলিস্কোপ এবং মাইক্রোস্কোপ ব্যবহারে উৎসাহী একাডেমি সদস্যদের রাজা দ্বিতীয় চার্লস 'পাগলের দল' বলে উপহাস করলেও অ্যাক্যাডেমি চর্চার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্র ও জনগণ লাভবান হয়েছিল। একাডেমিকগুলির প্রচেষ্টায় ব্যবহারিক বিজ্ঞানের অনুশীলন ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্রকৃতি ও বাস্তব জীবনের পক্ষে প্রয়োজনীয় বহু বিষয়কে বিজ্ঞান চর্চার পরিধির মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছিল। ফলে মহাকাশ গবেষণা থেকে শুরু করে কাপড়ে রং করা পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। ফলে কৃষি শিল্প ও কারিগরি উৎপাদনের বিজ্ঞানের প্রয়োগের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। আবার ভৌগোলিক আবিষ্কার, শিল্প বিপ্লব-- সবকিছুই ছিল বিজ্ঞান সাধনার উপর নির্ভরশীল। সুতরাং আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণে একাডেমিগুলির অবদান অনস্বীকার্য

 Thanks for reading.

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য

আরবদের সিন্ধু অভিযান | কারণ ও তাৎপর্য Please visit our Homepage and subscribe us. Suggested Topics || Ghajnavid Invasion || গজনী আক্রমণ || || মামুদের সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন || Somnath Temple Plunder || || তরাইনের যুদ্ধ ও তার গুরুত্ত্ব || মহম্মদ ঘুরির ভারত আক্রমন ও তার চরিত্র || সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...