সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

Mughal Harem | মুঘল হারেম

Abdul Mojaffar Mondal
Assistant Professor, Sonarpur Mahavidyalaya

Mughal Harem | মুঘল হারেম

মুঘল যুগের ইতিহাস চর্চায় সবচেয়ে জল্পনা এবং কৌতূহলের বিষয় হল মুঘল হারেম। রাজদরবারের মহিলা এবং তাঁদের সখি ও সহযোগিনীদের বসবাসের জন্য নির্দিষ্ট স্থান 'হারেম' নামে পরিচিত। হারেম শব্দের উৎপত্তি আরবি শব্দ 'হারাম' থেকে, যার অর্থ নিষিদ্ধ। মুঘল রমণীদের বসবাসের স্থানে বিশেষ কারন ছাড়া, যেমন: শিক্ষা ও চিকিৎসা, পরপুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। হারেমের তুর্কি প্রতিশব্দ সেরাগলিও, পারসিক প্রতিশব্দ জেনানা, এবং সংস্কৃত প্রতিশব্দ  অন্ত:পুর।

মুঘল হারেমের ব্যাপারে খুবই অল্পসংখ্যক তথ্য পাওয়া যায়। কোন প্রত্যক্ষ বিবরণ নেই। যেটুকু পাওয়া যায় তার প্রধান উৎস ইউরোপীয় পর্যটকদের কাহিনি, যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের মনগড়া কথা লিখে গেছেন এবং সেগুলিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, যেখান থেকে সত্য উদ্ধার করা সহজ নয় ।

অনেকেই বলে থাকেন যে, সম্রাটের হেরেমের সব মহিলাই তাঁর স্ত্রী, উপপত্নী, নর্তকী, বাইজি, গায়িকা ও বাঁদি। এই ভাবনা সঠিক নয়। এই ধরনের মহিলা অবশ্যই থাকতেন। তবে তারাই সব নয়। সম্রাটের মাতা, সৎমা, দুধমা, দাদি, নানী, খালা, চাচি, ফুফু, বোন, কন্যা, পুত্রবধূ ও নানা আত্মীয়-স্বজন সেখানে থাকতেন। এমনকি শিশু শাহজাদারাও হারেমে বড় হত। জাহাঙ্গীর প্রথম শাহজাদা হিসাবে হারেমে বড় হয়েছিলেন। রানি এবং রাজপরিবারের মহিলা সদস্যদের পোষ্য ও সখিরাও হারেমের বাসিন্দা হিসাবে থাকতেন। এছাড়া হারেমের নানা প্রয়োজনে নানা পদে মহিলা নিয়োগ করা হত। পাহারা দেওয়ার জন্য খোঁজা সৈনিক নিযুক্ত করা হত। শাহজাদা এবং শাহজাদী দের শিক্ষক শিক্ষিকারাও  মহলে অনেক সময় থাকতেন। খবরাখবর সম্রাটের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য গোয়েন্দা রাখা হত। এমনকি রানী, শাহজাদীদের নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনীও থাকত।

মুঘল হারেম ছিল শহরের মধ্যে ভিন্ন একটি শহর। হারেমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল যথেষ্ট আঁটোসাঁটো। এলাকাটি পাচিল দিয়ে ঘেরা থাকত। মহলের গেটে থাকত পাহারাদার সশস্ত্র নারী সৈনিক। গেটের বাইরে থাকত খোঁজা সেনাবাহিনী। আর কিছু দূরে মোতায়েন থাকত বিশ্বস্ত রাজপুত সেনাদল। তারপর থাকতো মূল সেনাবাহিনী। পুরো হারেমকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হত। প্রতিটি বিভাগের দায়িত্বে থাকতেন একজন করে মহিলা কমান্ড্যান্ট।

খুব প্রয়োজন না পড়লে অন্দরমহলের লোকজন বাইরে আসতেন না। তবে হারেমের ভিতরে তারা ইচ্ছা মত চলাফেরা করতে পারতেন এবং ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের যথেষ্ট সামগ্রী সেখানে থাকত। প্রত্যেক অ্যাপার্টমেন্ট  বা মহলে পৃথক বাসস্থান, বাগান, হাম্মামখানা, ঝরনা ও চৌবাচ্চা ছিল। পড়াশোনা করার জন্য একেকজনের লাইব্রেরি ছিল। শেখ সাদির গুলিস্তা ও বোস্তা ছিল জনপ্রিয় পুস্তক। দরবারী কারখানা থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং বিলাস সামগ্রী আসত। হারেমে অবসর বিনোদনের যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল। সংগীত, নৃত্য, ইনডোর গেম এর ব্যবস্থা ছিল। সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল লুকোচুরি এর ব্যবস্থাও করা ছিল।

একথা ভাবা ভুল যে, অন্তঃপুরের মহিলাগণ কেবল জৈবিক কাজকর্মেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। রাজনীতিতে মুঘল মহিলাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে মহাম আনগা, নূরজাহান, জাহানারা এবং রওশনআরার নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গুলবদন বেগম এর স্মৃতিকথা মুঘল ইতিহাসের মূল্যবান দলিল। মমমতাজমহল ছিলেন একজন সাহিত্যরসিক। নুরজাহান ছিলেন একজন কবি ও চিত্রকর। ছদ্মনামে তিনি কবিতা লিখতেন। আওরঙ্গজেবের অন্যতম কন্যা জেবুন্নেসা ছিলেন কোরআনে হাফেজ। তার আরবি ও ফার্সি ভাষার দক্ষতা উল্লেখযোগ্য। তার রচিত কাব্য গ্রন্থের নাম 'দিওয়ানা-ই-মাখফি'। তিনি একজন ভালো ক্যালিগ্রাফারও বটে। 

সর্বোপরি মুঘল হারেমে পারস্পরিক সমঝোতা ও সৌহার্দ্য বজায় ছিল। একে অপরের প্রতি শত্রুতা থাকলেও কেউ প্রকাশ করতেন না। মাতা, স্ত্রী ও কন্যা দের প্রতি মুঘল শাসকদের সম্ভ্রম, মর্যাদা ও স্নেহ থাকত। নিজের মা ছাড়াও তারা দুধ মা, সৎমার প্রতিও যথেষ্ট মর্যাদাশীল থাকতেন।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...