সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইলবার্ট বিল বিতর্ক

Abdul Mojaffar Mondal
Assistant Professor, Sonarpur Mahavidyalaya

ইলবার্ট বিল বিতর্ক

দি জাতীয়তাবাদীরা বিভিন্ন বড়লাটের মধ্যে তফাৎ এর ব্যাপারে খুবই ওয়াকিবহাল ছিলেন। বিশেষ করে লিটন আর রিপনকে প্রায় কালো আর সাদার ফারাক হিসেবে দেখা হত। প্রতিক্রিয়াশীল লিটন 1876 থেকে 1880 সাল পর্যন্ত এদেশে রাজপ্রতিনিধি ছিলেন। তারপর রিপন ভাইসরয় নিযুক্ত হন। শিক্ষিত ভারতীয়দের ক্রমবর্ধমান ক্ষোভের কারণ বুঝতে পেরে রিপন এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা শিক্ষিত উচ্চবর্গের ভারতীয়দের খুশি করেছিল। যেমন তিনি ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট বাতিল করেছিলেন এবং তার স্বায়ত্তশাসন নীতি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন। রিপনের গৃহীত পদক্ষেপ গুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ ছিল ইলবার্ট বিল।
1883 সালে 2রা ফেব্রুয়ারি ভাইসরয়ের কাউন্সিলের আইন সদস্য ইলবার্ট একটি বিল উত্থাপন করেন। এই বিল ভারতীয় সিভিলিয়ানদের মফস্বলের ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করার ক্ষমতা দিতে চেয়েছিল। এর আগে ফৌজদারী কার্যবিধি অনুযায়ী কেবলমাত্র ইউরোপীয় ম্যাজিস্ট্রেট, দায়রা জজ, জাস্টিসেস অফ পিস অপরাধী ইউরোপীয়দের বিচার করার অধিকারী ছিলেন। ইলবার্ট অযৌক্তিক জাতিভিত্তিক বাধা দূর করতে চেয়েছিলে। তবে ভারতীয় জজ দের একজন শ্বেতাঙ্গ অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়নি। হেবিয়াস কর্পাসও বজায় ছিল।
কিন্তু ভারতে বসবাসকারী ইউরোপীয় এবং অংলো ইন্ডিয়ান রা ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাদের অসন্তোষ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে অনেকেই এই বিক্ষোভকে 'শ্বেত বিদ্রোহ' বলে আখ্যায়িত করেন। এমনকি ইংল্যান্ডের লিবারেল সরকার এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লিবারেল সদস্যরাও পর্যন্ত এ বিষয়ে রিপন কে সমর্থন জানানোর ক্ষেত্রে ইতস্ততঃ করেছিল। তাই বাধ্য হয়ে রিপন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের সাথে সমঝোতায় আসেন। সিদ্ধান্ত হয় যে শ্বেতাঙ্গদের বিচারের সময় সমসংখ্যক শ্বেতাঙ্গ ও ভারতীয় জুরি থাকবে।
রিপনের এই সমঝোতা ভারতীয় শিক্ষিতদের হতাশ করেছিল। কিন্তু তারা প্রতিবাদের মাত্রা বৃদ্ধি করার সাহস পায়নি, পাছে রিপনের অন্যান্য প্রগতিশীল সংস্কারগুলি বাতিল না হয়ে যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য রিপন ব্যক্তিগতভাবে উদারপন্থা বিশ্বাসী হলেও তিনি কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের প্রতিনিধি হয়েই এদেশে এসেছিলেন। তার ভারত বন্ধু' সাজার ব্যাপারটি আসলে সাম্রাজ্যবাদী কৌশলমাত্র।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...