সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কামসূত্রে বর্ণিত গুপ্তযুগে নাগরকদের জীবনচর্যা | The Life of Nagarakas in the Gupta Era as Depicted in the Kamasutra

কামসূত্রে বর্ণিত গুপ্তযুগে নাগরকদের জীবনচর্যা

গুপ্ত যুগে সম্ভ্রান্ত নগরবাসীদের বলা হত নাগরক। বাৎসায়ন রচিত কামসুত্রে এই নাগরকদের জীবনচর্যার একটি মনোজ্ঞ বিবরণ আছে। নাগরকরা প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। কৃষিজ উৎপাদনের উদ্বৃত্ত এবং সফল বাণিজ্য পরিচালনার মাধ্যমে এরা প্রভূত সম্পদ উপার্জন করেছিলেন। সম্পত্তির অপ্রতুলতার ছাপ পড়েছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে। একটি বিশেষ ধরনের জীবনে তারা অভ্যস্ত ছিল, যেখানে প্রতিনিয়ত ভোগ বিলাস এবং সাংস্কৃতিক রুচির সংমিশ্রণ লক্ষণীয়।

নাগরকদের আবাস ছিল বিলাসবহুল। অন্দরমহল পরিবারের নারীদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। প্রতিটি কক্ষ এক একটি উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো। শয়ন কক্ষে থাকতো দুটি সুখপ্রদ শয্যা ও বালিশ, দেয়ালে কুলুঙ্গি ও তাক এবং সেই তাকে বীণাযন্ত্র, অঙ্কন সামগ্রী, পুস্তক ও মাল্য থাকতো। মেঝেতে পিকদানি এবং এক পাশে পাশা ও দাবা খেলার ছক থাকতো। স্তম্ভযুক্ত বারান্দা ছিল এবং দেয়ালে নানা রংয়ের কারুকার্য ছিল। ঘরের মেঝে মূল্যবান পাথর বা টালি দিয়ে নির্মিত হতো। বাইরে সম্মুখে থাকতো ফুল ও ফলের বাগান। সেই বাগানে গ্রীষ্মকালে বিশ্রামের জন্য একটি জলবেষ্টিত সমুদ্রগৃহ থাকত। বাগানে একটি পক্ষীনিলয়ও থাকত।

নাগরক সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃকৃত্য সম্পাদনের পর দেহে চন্দনের সুগন্ধি মেখে দর্পণ সহযোগে পোশাক-পরিচ্ছদ পরে মুখে মসলাযুক্ত পান দিয়ে বিষয়কর্ম শুরু করতেন। মধ্যাহ্নভোজনের আগে স্নান করতেন। স্নানের সময় তাঁরা একদিন অন্তর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মালিশ করাতেন, দুই দিন অন্তর ফেনক বা সাবান মাখতেন, তিনদিন অন্তর দাড়ি কমাতেন। সাধারণত দিনে দুইবার খাদ্য গ্রহণ করতেন। খাদ্য গ্রহণের সাথে একটি বিশেষ পানীয় এবং মিষ্টান্ন ভক্ষণ করতেন। মধ্যাহ্নভোজের পর তারা পাখি কে বুলি পড়ানো বা মোরগ লড়াই দেখার মত কাজে কিছুটা সময় অতিবাহিত করযেন অথবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্পগুজব করতেন। এরপর একটা ছোট দিবানিদ্রা নিতেন।

সন্ধ্যায় নাগরক 'গোষ্ঠী' বা সামাজিক মেলামেশার স্থলে যেতেন, যা আধুনিক ক্লাবের সঙ্গে তুলনীয়। সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে নানা ধরনের বাক্য আলাপ অথবা বিভিন্ন কলাবিদ্যায় নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করতেন। সেখানে খানাপিনা হত। কখনো কখনো  গণিকার গৃহেই নাগরকদের গোষ্ঠী বসত। গোষ্ঠীতে শুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় বক্তৃতা রাখা ছিল অতি সম্মানের বিষয়। এছাড়া প্রতি মাসে সরস্বতীর মন্দিরে একটি করে নাগরক সম্মেলন হত এবং সেখানে গায়ক-গায়িকা, নর্তক-নর্তকী ও কলাকুশলীদের বিপুলভাবে পুরস্কৃত করা হতো।

রাত্রে নাগরকরা কন্ঠ ও যন্ত্রসংগীত এবং কখনো কখনো নৃত্য উপভোগ করতেন। অতঃপর সঙ্গিনীরা আসলে তাদের সঙ্গে সম্বর্ধনাসূচক আচরণ এবং মিষ্টিমধুর আলাপচারিতা হতো। কখনো কখনো এদের মধ্যেই কোন একজন নাগরকের শয্যাসঙ্গিনী হতেন। কখনো কখনো কোন একজন গনিকা একজন বিশেষ নাগরকের প্রতি আকৃষ্ট হতেন। এরা এক পরিগ্রহা। মনে রাখতে হবে নাগরকের কিন্তু একটা দাম্পত্য জীবনও ছিল। তার স্ত্রী একজন 'আদর্শ স্ত্রী' হবেন তা-ই আশা করা হত।

গতানুগতিক জীবনের বাইরে তাঁরা কখনও কখনও ভ্রমণে যেতেন বা মদ্যপানের উদ্দেশ্যে একত্রিত হতেন বা পিকনিক জাতীয় কিছু আয়োজন করতেন বা কৃত্রিম সরোবরে জলক্রীড়ার আয়োজন করতেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের সাথে গণিকা বা সঙ্গিনী উপস্থিত থাকত। কখনো কখনো কোন সামাজিক উৎসব উপলক্ষে তারা রাত জেগে পাশা খেলতেন। কতকগুলো জনপ্রিয় উৎসব ছিল বসন্ত উৎসব, হোলি, হিন্দল উৎসব প্রভৃতি। পরিশেষে, মনে রাখতে হবে এই বিশেষ শ্রেণীর অস্তিত্ব গুপ্ত যুগের পরে আর দেখা যায় না।

The Life of Nagarakas in the Gupta Era as Depicted in the Kamasutra

During the Gupta era, the affluent urban dwellers were referred to as Nagarakas. The Kamasutra, written by Vatsyayana, provides a captivating account of their lifestyle. These Nagarakas were wealthy individuals who had amassed great fortunes through agricultural surplus and successful trade enterprises. Their prosperity was reflected in their daily lives, which were marked by a blend of luxury, indulgence, and refined cultural tastes.

Residence and Living Arrangements

The Nagarakas resided in lavish mansions. The inner quarters were designated for women, and each room served a specific purpose. The bedroom typically contained two comfortable beds with pillows, along with wall niches and shelves that housed musical instruments (such as the Veena), painting materials, books, and garlands. The floor had spittoons and designated areas for playing dice and chess. A pillared veranda surrounded the house, with colorful artwork adorning the walls. The floor was often made of precious stones or decorative tiles.

The front yard featured gardens filled with flowers and fruit-bearing trees, and within these gardens, there was a waterfront summer house, designed for relaxation during the hot season. Additionally, a bird sanctuary was often part of the estate.

Daily Routine of the Nagaraka

The Nagaraka’s day began with waking up and performing morning rituals. Afterward, they applied sandalwood-scented perfumes and dressed while gazing into a mirror. They then chewed betel leaves and proceeded with their daily affairs.

Before lunch, they took a bath, following a specific bathing routine:

  • Body massage every alternate day
  • Application of soap or cleansing foam every two days
  • Shaving every three days

They typically ate twice a day, often accompanied by a special beverage and sweets.

After lunch, they engaged in leisure activities, such as:

  • Teaching birds to mimic speech
  • Watching cockfights
  • Conversing with friends

Following this, they would take a short afternoon nap.

Evening Social Life

In the evening, Nagarakas visited social gatherings known as "Goshti", which were similar to modern clubs. Here, they engaged in:

  • Intellectual discussions
  • Displaying their skills in various arts
  • Enjoying food and drinks

Sometimes, these gatherings took place in the houses of courtesans (Ganika). Delivering eloquent speeches in refined Sanskrit was considered a matter of great prestige.

Additionally, every month, a Nagaraka assembly was held at the temple of Saraswati, where singers, dancers, and artists received generous rewards.

Nighttime Entertainment and Companionship

At night, Nagarakas enjoyed:

  • Vocal and instrumental music
  • Occasionally, dance performances

They were then joined by their companions, with whom they engaged in affectionate conversations. Sometimes, a courtesan would become particularly fond of a specific Nagaraka and would remain exclusive to him (Ekaparigraha). However, it is important to note that Nagarakas also had a married life, where their wives were expected to be ideal spouses.

Festivals and Extravagant Pastimes

Beyond their routine, Nagarakas occasionally went on excursions, hosted drinking parties, arranged picnics, or organized water sports in artificial lakes. They were always accompanied by courtesans or female companions.

During social festivals, they sometimes stayed awake all night playing dice. Popular festivals among them included:

  • Vasant Utsav (Spring Festival)
  • Holi
  • Hindola Utsav

Decline of the Nagaraka Class

Ultimately, this elite urban class disappeared after the Gupta era, marking the end of an opulent and culturally vibrant way of life.

মন্তব্যসমূহ

  1. স্যার গণিকা কারা ছিলো ?
    গোনিকাদের কাজ কী ছিলো?

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. সমাজের দেহোপজীবিনীদের গনিকা বলা হয়। এদের কাজ হল দেহ ও মন সহযোগে খরিদ্দার দের আনন্দ দেওয়া। অন্য শব্দে যাদের বলা হয় বেশ্যা। গুপ্ত যুগে গনিকাদের বাৎস্যায়ন দুভাগে ভাগ করেছেন। এক, শিক্ষিতা গণিকা বর্গ। এরা চৌষট্টি কলায় পারদর্শিনী এবং এদের খদ্দের মূলত উপরতলার সম্ভ্রান্ত মানুষেরা। দুই, সাধারন দেহোপজীবিনী অর্থাৎ বেশ্যা। বাৎসায়ন গণিকাদের কিছু পেশাগত উপদেশ দিয়েছেন। যেমনঃ অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত না হওয়া, প্রেমে না পড়া এবং রাষ্ট্রীয় আইন কানুন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা। আলোচ্য পর্বের কয়েকজন প্রথিতযশা গণিকা হলেন বসন্তসেনা, রাগমঞ্জুরী, চন্দরসেনা প্রমূখ।

      মুছুন
  2. চাণক্য অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে গণিতের বিভিন্ন কাজে নিয়োগের কথা বলেছেন। তিনি এও বলেছেন যে গণিকাদের একজন প্রধানা থাকবেন যিনি গণিকাদের নিয়ন্ত্রণ করবেন অর্থাৎ তিনি গণিকা নিয়ন্ত্রক বা অধ্যক্ষা নিয়োগের কথা বলেছেন ।শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক গ্রন্থে বসন্তসেনা ও চারু দত্তের প্রেম কাহিনী বর্ণিত আছে যেখানে বসন্তসেনা ছিল একজন গণিকা।

    উত্তরমুছুন
  3. Sir, ata charao to apni bole6ilen j aro ki6u nagorok der saporke study material daben.

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...