Abdul Mojaffar Mondal
Assistant Professor, Sonarpur Mahavidyalaya
ভারতীয় অর্থনীতিতে রেলপথ স্থাপনের প্রভাব
ভারতবর্ষে আধুনিক অর্থনৈতিক পরিকাঠামো উন্নয়নে রেলপথ নির্মাণকে ব্রিটিশ শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে মনে করা হয়ে থাকে। রেলপথ নির্মাণের ফলে জাতীয় ভূখণ্ড হিসেবে ভারতের স্থানীয় এলাকা গুলি পরস্পরের সাথে যুক্ত হয় এবং সেই এলাকাগুলি আবার বহির্জগতের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। তবুও যেভাবে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছিল তাতে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে; এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থ পূরণ করা, ভারতীয় অর্থনীতির প্রয়োজন মেটানো নয়।
1853 খ্রিস্টাব্দে লর্ড ডালহৌসির সময় প্রথম ভারতে রেলপথ চালু হয়। উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীর যাতায়াত কে সহজ করা, যাতে সারা দেশের জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। দ্বিতীয়তঃ ভারতের বাজার গুলিকে যুক্ত করা যাতে আমদানিকৃত ব্রিটিশ পণ্য ভারতীয় বাজারে সহজে পোঁছে যায় এবং কাঁচামাল প্রাপ্তির জায়গা গুলি কে শহর ও বন্দর এলাকার সাথে জুড়ে দেওয়া যায়। মাল পরিবহনে পক্ষপাতমূলক ভাড়ার ব্যবস্থা ছিল। বিপুল পরিমাণে প্রস্তুত দ্রব্য বন্দর থেকে দেশের ভিতরে কোন স্থানে কম ভাড়ায় পৌঁছে যেত, কিন্তু দেশের ভেতর থেকে প্রস্তুত দ্রব্য বন্দরে আনতে বেশি ভাড়া লাগত। আবার উল্টোদিকে বন্দর থেকে কাঁচামাল দেশের ভিতরে কোন স্থানে নিয়ে যেতে গেলে বেশি ভাড়া লাগতো এবং দেশের ভেতর থেকে বন্দরে কাঁচামাল আনার জন্য ভাড়া কম লাগতো অর্থাৎ রেলপথ স্থাপন ভারতীয় শিল্পের অগ্রগতির পথে একটি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল এবং ঔপনিবেশিক শোষণকে ত্বরান্বিত করেছিল -- একথা বোঝাই যায়।
উনিশ শতকে ব্রিটেনসহ ইউরোপের উন্নত দেশগুলিতে রেলপথ স্থাপন আধুনিক শিল্পের বিকাশ কে ত্বরান্বিত করেছিল। ভারতের ক্ষেত্রে কিন্তু তা হয়নি বরং ব্রিটিশ অর্থনীতি ভারতের রেলপথ সম্প্রসারণ এর দ্বারা লাভবান হয়েছিল। কারণ যন্ত্রাংশ, লোহার লাইন, এমনকি একটা সময় পর্যন্ত কয়লাও ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হত। রেল লাইন পাতা, সেতু নির্মাণ, সুরঙ্গ কাটা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নিম্নমানের প্রযুক্তি ভারতীয়দের শেখানো হত। উচ্চ প্রযুক্তিগত দক্ষতা ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করা হত, যাতে প্রকৃতপক্ষে কোন জাতীয় প্রযুক্তি না গড়ে ওঠে।
ম্যাক আলপিন এবং জন হার্ড লিখেছেন, রেলপথের বিস্তার কৃষির বাণিজ্যিকীকরণের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছিল। কৃষকরা পরিবহন সংক্রান্ত ব্যয় হ্রাসের সুযোগ নিয়েছিল এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য আরো বেশি করে রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু গোটা ভারতের বিচারে দেখা যায় এই বক্তব্য আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। সমগ্র ভারতে খুব স্বল্প এলাকাতেই রেলপথ পাতা হয়েছিল। তাছাড়া রেলপথের শেষ প্রান্ত - যা ছিল গ্রামাঞ্চলের উৎপাদন কেন্দ্র ও রেলপথের যোগসূত্র- তা আদৌ কৃষক স্বার্থের অনুকূল ছিল না।
জাতীয়তাবাদীরা অভিযোগ করে থাকেন যে, ভারতের রেলপথের বিস্তার ভারতীয় সম্পদ বহির্গমনের পথ প্রশস্ত করেছিল। যদিও ব্রিটিশ পুঁজিপতিরা পুঁজি বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধানে আগ্রহী ছিলেন। তথাপি সুদূর ভারতে রেলপথের জন্য বিনিয়োগ করার ঝুঁকি ছিল। তাই অনেকেই পুঁজি বিনিয়োগে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তাই পুঁজি বিনিয়োগকারী রেল কোম্পানিগুলির শেয়ারের 5% চুক্তি মাসিক সুদ দেওয়া শুরু হয়। এর ফলে বিদেশি কোম্পানিগুলো ইচ্ছামত হারে অর্থ ব্যয় করে যার চাপ এসে পড়ে ভারতীয় করদাতাদের উপর। তাছাড়া সুদ দিতে হত স্টারলিং পাউন্ডের মাধ্যমে। 1870 নাগাদ টাকার দাম পড়ে যাওয়ায় চুক্তি মাফিক সুদ গিয়ে পাউন্ডের হিসাবে বহু টাকা ভারত থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে।
তবে রেলপথ স্থাপনের একটা সুবিধা হয়েছিল, তা হল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে যোগসুত্র অনেক সহজ হয়েছিল। আদান-প্রদান বৃদ্ধি পেয়েছিল। এবং এই রেলপথ ব্যবহার করেই জাতীয়তাবাদী নেতারা জাতীয়তাবাদ প্রচারে সুবিধা পেয়েছিল।

1853 সালে 16 ই এপ্রিল লড ডালহৌসি ভারতীয় রেলপথের সূচনা করেছিলেন
উত্তরমুছুন