অষ্টাদশ শতক ইউরোপ জ্ঞানদীপ্তির যুগ। এই জ্ঞান দীপ্তির সূচনা হয়েছিল ষষ্ঠ শতকে হিউম কান্ট ও প্রমুখ দার্শনিকদের হাতে ধরে। ফ্রান্স ছিল জ্ঞান দীপ্তির অন্যতম একটি কেন্দ্র। ফ্রান্সের জ্ঞান দীপ্তির ধারকদের বলা হয় ফিলজফ। তবে এরা কেবল দর্শনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এদের পরিধি ছিল আরো ব্যাপক সমকালীন ফরাসি সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র ব্যবস্থা, অর্থনীতি ইত্যাদি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি বর্তমান ছিল সে সম্পর্কে ফরাসি দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছে। তবে এই দার্শনিকদের প্রত্যেক প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি এক ছিল না। কিন্তু এরা প্রত্যেকেই ছিলেন যুক্তিবাদী মানবতাবাদী এবং সংস্কারের সমার্থক।
ফেনেলো থেকে ফ্রান্সের যুক্তিবাদের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রাক বিপ্লব ফ্রান্সের সর্বপেক্ষা খ্যাতনামা দার্শনিক ছিলেন মন্তেস্কু। তিনি নিয়ম তান্ত্রিক রাজতান্ত্রে বিশ্বাসী এবং সমসাময়িক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আস্থাহীন। তিনি তার রচিত "পার্শিয়ান লেটার" গ্রন্থে তিনি সমকালীন ফ্রান্সের স্বৈরাচার, দুর্নীতি, অভিজাতন্ত্রের স্বার্থপরতা ও চার্চের গোড়ামী প্রকাশ করে দেয়। "গ্রেডনেস এন্ড ভেকাভেস্ন অব দি রোমানস" গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন যে ভৌগলিক পরিবেশ, জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ ইত্যাদি একটি দেশের জীবনযাত্রা, আইন, শাসন, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদির উপর প্রভাব বিস্তার করে। রোমান আইনের তিনি প্রশংসা করেন। কারণ রোমান আইন রোমে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পেরেছিল। মন্তেস্কুর শ্রেষ্ঠ রচনা "স্পিরিট অফ দি লস" এই গ্রন্থে তিনি তার বিখ্যাত ক্ষমতা বিভাজন তথ্য ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে শাসন, আইন প্রণয়ন ও বিচার ক্ষমতা বিভক্ত হলে জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার রক্ষা পায়। তাই এই তত্ব বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। মন্তেস্কুর চিন্তাধারা খুব একটা বহিঃপ্রকাশ ছিল না। অভিজাত দের সুযোগ-সুবিধা ও সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থেই রাজতন্ত্রকে সীমাবদ্ধ করার কথা বলেছিলেন। ব্যক্তি স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখতে পারে বলে তিনি ক্ষমতায় বিভাজনের কথা বলেন। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে তিনি ক্ষমতার সম্পূর্ণ পৃথকীকরণের কথা বলেননি, ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার কথা বোঝাতে চেয়েছেন।
এ যুগের একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ এবং দার্শনিক ছিলেন ভলতেয়ার। তিনি তার রচিত "ফাঁদিদ" গ্রন্থে তৎকালীন ফ্রান্সের চার্চের দুর্নীতি ও ভ্রষ্টাচারকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। তিনি চার্চ ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে বলেন। চার্চ ব্যবস্থা ভাঙলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে বলে তিনি মনে করতেন। তবে তিনি নাস্তিক ছিলেন না, ধর্মীয় সহিষ্ণুতাই বিশ্বাসী ছিলেন। ১৭৩৪ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ "লেতর ফিনোজফিক" এই গ্রন্থে তিনি পুরাতন তন্ত্রকে আক্রমণ করেন এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা প্রচার করেন। তিনি গণতন্ত্রের কথা বলেননি। তিনি জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার গুণগান করেন। তিনি আইন ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের প্রস্তাব দেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রচলিত প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেন জ্যাক রুশো। তিনি তার "কনফুসিয়ান" গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন যে মানুষ সম্ভবত সৎ কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতিতে সে অসৎ হয়ে পড়ে। ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ "সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট" এই গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন মানুষের আদিম জীবন ও ক্রমরুপান্তরের মধ্য দিয়ে সংঘবদ্ধতার কাহিনী। তিনি দেখিয়েছেন সভ্যতার সূচনা লগ্নে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব হলে সমাজ প্রশাসন, আইন, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি গড়ে ওঠে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে। মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন কিন্তু সমাজ তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রেখেছে। রুশোর মতে শাসক ও শোষিতের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। শোষিত শ্রেণীর ইচ্ছাই প্রতিফলিত হলো রাষ্ট্র তাই সরকার সাধারণের ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে বাধ্য। জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করতে না পারলে সরকারকে গদিচ্যুত করার অধিকার জনগণের আছে। এভাবে রাজার দৈব ক্ষমতাকে নস্যাৎ করে গণতন্ত্রের কথা তুলে ধরেছেন। জনগণের উপর রুশোর প্রভাব ছিল সর্বাত্মক। তার বইপ্রেমিক আদর্শ জনগণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
অষ্টাদশ থেকে যুক্তিবাদী মানসিকতা গঠনে সাহায্য করেন বিশ্বকোষ রচয়িতাগন, দিদেরো, এলেমবার্ট, প্রমুখ ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা । দিদেরোর সম্পাদনায় ১৭৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় বিশ্বকোষ। ধর্ম ও রাজনীতি সম্পর্কে বিশ্বকোষের বিশ্লেষণ মানুষকে যুক্তি নির্ভর ধারণা গ্রহণে সাহায্য করেছিল। মাবলি ফরাসি সমাজ ও অর্থনৈতির তীব্র সমালোচনা করে প্রজাতন্ত্র ও গণতন্ত্রকে সমর্থন করেন। মাবলি ফরাসি চার্জ, অভিজাত সম্প্রদায় ও রাজতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আহবান করেন। মাবলী ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও বংশগত অধিকারের বিলোপের কথা বলে।
বিপ্লবের প্রাক্কালে বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গোষ্ঠীর নাম হল ফিজিওক্রাফট। অর্থনীতিবিদ ফুয়েসনে ছিলেন এর নেতা। ফুয়েসনে দীর্ঘকাল ধরে ফ্রান্সের অর্থনীতিতে পরিচালিত মার্কেন্টাইল বাদের সমালোচনা করে, ইংরেজ অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ এর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ মুক্ত কৃষি শিল্প বাণিজ্যের পক্ষে মত প্রকাশ করে।ফুয়েসনে এর লেখা গ্রন্থের নাম "ইয়াবলো ইকোনমি"। তারা ফ্রান্সের সর্বোপরি আর্থিক নীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ, অভ্যন্তরীণ শুল্ক ইত্যাদির সমালোচনা করেন। এবং অবাধ বাণিজ্য নীতি, খাদ্যশস্যের খোলা বাজার দাবি করেন। তারা ভূমিকর থেকে কাঠকে ছাড় না দেওয়ার দাবি করেন।
বিপ্লবের জন্মলগ্ন থেকে, এর সাথে দার্শনিকদের সম্পর্ক নিয়ে বিতর্কে সৃষ্টি হয়েছে। একদল মনে করেন বিপ্লবের সাথে দার্শনিকদের চিন্তাভাবনার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না, ছিল পরোক্ষ সম্পর্ক। বিপ্লব শুরু হলে এর উপর দার্শনিকদের প্রভাব পড়েছিল মাত্র। দার্শনিকরা ছিলেন অভিজাত, বুর্জোয়া, আইনজীবী, বণিক, পুরনো ব্যবস্থার সুবিধা গুলি এই ব্যবস্থা দ্বারা ভেঙে দিতে চাইনি। অন্যদিকে জর্জ রুডে বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন।তার মতে অর্থনৈতিক দুর্দশা, সামাজিক ক্ষোভ, রাজনৈতিক ও সামাজিক উচ্চাশার ব্যর্থতা শুধু বিপ্লব নিয়ে আসে না। জনগণের ক্ষোভ, আশা, আকাঙ্খাকে সমন্বিত রূপ নিতে ও মনোলোক গঠনে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা থাকে। মনে রাখতে হবে সে যুগে কোন রাজনৈতিক দল ও কর্মসূচি ছিল না, দার্শনিকরা সেই অভাব পূরণ করেছিল। তারা জনগণকে সচেতন করে পরিবর্তনের দাবি গুলি তুলে ধরেছিল এবং কোন কোন ক্ষেত্রে প্রয়োজনে তা চিহ্নিত করে দিয়েছিল।
এডমন্ড বাট বিপ্লবের অন্যতম কারণ হিসেবে দার্শনিকদের ষড়যন্ত্র কে দায়ী করেছেন। তার মতে ফ্রান্সের মতো অচল অবস্থা অন্যান্য দেশেও ছিল যা সংস্কারের মাধ্যমে কাটিয়ে ওঠা যেত। দার্শনিকরা জনগণকে উত্তপ্ত করে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। তারা বিপ্লবের জন্য জনগণের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ক্ষোভ কে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কোবান লিখেছেন যে দার্শনিকদের চিন্তাভাবনা ছিল পরস্পর বিরোধী এদের সাধারণ কর্মসূচি ছিল না।
ঐতিহাসিক ডেবিট টমসন বলেছেন ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে সামগ্রিক বিপ্লবিক পরিস্থিতিতে বিপ্লবের জন্য দায়ী দার্শনিকদের রচনাবলী। মানুষের মনে পুরানো ব্যবস্থা সম্পর্কে অশ্রদ্ধা সৃষ্টি করেছিল। জনগণ পুরানো ব্যবস্থার সমালোচনা শুরু করে । বিপ্লব শুরু হলে দার্শনিকদের প্রভাবে নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। বিপ্লবী পরিস্থিতি সৃষ্টিতে দার্শনিকদের বিশেষ কোনো অবদান নেই বলে তিনি মনে করেন।
ঐতিহাসিকদের একাংশ মনে করেন মন্তেস্কু রক্ষণশীল ছিলেন। ভলতেয়ার জ্ঞানদীপ্ত স্বৈরাচারে বিশ্বাসী ছিলেন। রুশো বিপ্লবের কথা বলেননি। তাছাড়া দার্শনিকদের চিন্তাভাবনার মধ্যেও মতপার্থক্য ছিল। দার্শনিকদের রচনাগুলির পাঠক ছিল শিক্ষিত বুর্জোয়া শ্রেণী। আর ফ্রান্সের অধিকাংশ লোক ছিল অশিক্ষিত।
এসব বলা সত্বেও বলা যায়, দার্শনিকরা ফ্রান্সের ঐতিহ্যগত রাষ্ট্র ও সমাজের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিলেন। বিপ্লবের উৎপত্তিস্থল ছিল বসার ঘর, ক্যাফে, রেস্তোরা, যেখানে দার্শনিক মতবাদ নিয়ে আলোচনা হতো, সাধারণ মানুষ এইসব শুনে অনেক কিছু জেনেছিল। তাছাড়া বিপ্লবের প্রাক্কালে ফ্রান্সে পত্রপত্রিকার সংখ্যা ছিল ইউরোপের সব দেশের চেয়ে বেশি। হাটে, বাজারে, অফিস, আদালত, থিয়েটার একাডেমী সর্বত্র এইসব নিয়ে আলোচনা হতো যা সাধারণ মানুষকে সচেতন করেছিল।
জর্জ লেফেভর বলেছেন ফ্রান্সের ইতিহাসের গভীরে নিহিত ছিল বিপ্লবের উৎস। মূল্যবৃদ্ধি ও আর্থিক দুর্গতির জন্য বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে বিক্ষোভ জমে ওঠে। আধুনিক কালে রাজনৈতিক দলগুলি যে ভূমিকা পালন করে সেখানে ফ্রান্সের দার্শনিকরা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ক্ষোভকে সঙ্গত রূপ ও ভাষা প্রদান করেছিল। দার্শনিকরা মানুষের মধ্যে পরিবর্তনমুখী মানসিকতা গঠন করে দিয়েছিল। সমগ্র বৈপ্লবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে জ্ঞানদীপ্ত বা দার্শনিকদের প্রচার বিপ্লব ঘটাতে পারে না। ফ্রান্সের সমাজ, অর্থনীতি, ধর্ম ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহিঃপ্রকাশ হয়েছিল বলেই দার্শনিকদের রচনা বিপ্লবী চেতনা সৃষ্টি করতে পেরেছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন