নগরায়ন মধ্যযুগের আর্থসামাজিক জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মুঘল আমলে বিবরণ গুলিতে সরাসরি নগরায়ন বিষয়ে উল্লেখ না থাকলেও রাজনৈতিক ও তার আনুসাঙ্গিক বিষয়ের বিবরণের নগরের উৎখান পতনের ইতিহাস পাওয়া যায়। সুলতানি যুগে নগরায়নের যে সূচনা হয়েছিল ২০০ বছরের মুঘল শাসনে তা অব্যাহত ছিল। সুলতানি যুগের পুরাতন শহর যেমন দিল্লী, লাহোর প্রভৃতির পুনরুত্থান ঘটেছিল, সেইসঙ্গে নতুন কিছু শহর যেমন এহালাবাদ, ফতেপুর সিক্রি, গুজরাট আর্কট ফারিদাবাদ প্রভৃতির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। নগর গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শাসক শ্রেণী ও মুঘল উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের পৃষ্ঠপোষকতা, উৎসাহ এবং সক্রিয় সহযোগিতা ছিল।
গ্রামবাসী কৃষিজীবীর, পুরবাসীতে রুপান্তর অর্থাৎ বড় শহরে পরিবর্তন এবং বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে শহর গড়ে ওঠা, এইসব কতগুলি ধীর অথচ স্বাভাবিক সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ফলে নগরায়ন সম্ভব হয়েছিল। প্রথমত মুঘল রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক স্থিরতা মানুষকে অধিকতর নিরাপত্তা ও শান্তির আশ্বাস জনগণকে প্রাচীর বেষ্টিত দুর্গের অভ্যন্তরে ও বাইরে বাস করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মুঘল রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ফলে দেশে যে মুদ্রার ওজনের তারতম্য যুদ্ধবিগ্রহ, আঞ্চলিক মুদ্রা ব্যবস্থা, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য শুল্ক প্রভৃতি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অসুবিধা গুলি দূর হয়। মুঘল শাসকদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি জনসাধারণ ও ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জনে সহায়ক হয়। দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার ফলে আন্তদেশীয় ও বৈদেশিক বাণিজ্য সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। শেরশাহের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, আকবরের মুদ্রা ব্যবস্থা সর্বত্র সমরূপে প্রশাসনিক ঐক্য এবং সচল মুদ্রা নির্ভর অর্থনীতি চালু হওয়ায় অভিজাত, শাসক ও ব্যবসায়িকগণ বাণিজ্যে আগ্রহী হয়। বাণিজ্যের উন্নতি বিশেষত সুতি বস্ত্রের আন্তর্জাতিক চাহিদার ফলে নগরায়নের প্রক্রিয়া দ্রুত সম্ভব হয়েছিল। গ্রামগুলিতে অর্থাভাবে জর্জরিত মানুষরা দলে দলে অর্থ উপার্জন ও উন্নত জীবনধারণের আশায় শহরগুলিতে ভিড় করতে থাকে।
দ্বিতীয়তঃ চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী মুঘল ভারতেও নদীতীর ও সমুদ্রতীর এর সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করা যায় এমন নগর গুলি তুলনামূলকভাবে বেশি সমৃদ্ধ ছিল। শীতল আবহাওয়া,পানীয় জলের সুবিধা, সহজলভ্য নৌ চলাচল ছিল এর প্রধান কারণ। যমুনার ধারে অবস্থিত দিল্লি এবং আগ্রা বাণিজ্যিক,রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। একই রকম রাভী নদীর তীরে লাহোর, করমন্ডল উপকূলের মাদ্রাজ ও সুরাট প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ শহরের পরিণত হয়। গভেষীকা রিনা ভাদুড়ি দেখিয়েছেন ইউরোপীয় বাণিজ্য থেকে মুনাফা অর্জনের আশায় ভারতীয় শাসক কূল নিশ্চয়ই শহর ও বন্দর প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল। পূর্ব উপকূলের প্রধান বন্দর মুসলিপত্তনাম এর মত নোংরা জেলেদের স্থান থেকে উন্নত বন্দর শহরে পরিণত হওয়া এর প্রকৃত উদাহরণ।
সাম্রাজ্যের রাজধানী, প্রাদেশিক রাজধানী জেলা প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে বেশ কতগুলি শহর গুরুত্ব পেয়েছিল। যেমন আগ্রা, দিল্লি, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি। মুঘল সাম্রাজ্যে প্রায় ২০০ টাকশাল ছিল এবং এগুলি সব গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিতে অবস্থিত ছিল।
এ যুগে মন্দির, মসজিদ তীর্থস্থান তথা ধর্মীয় সৌধকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু নগর গড়ে উঠেছিল যেমন আজমির, মথুরা, বেনারস, মুলতান, এহালাবাদ, পুরি মাদুরা, তিরুপতি প্রভৃতি।
নগরায়নের অন্যান্য কারণ থাকতে পারে যেমন দিল্লি ছিল পিতল ও তামার জিনিসের উৎপাদন কেন্দ্র। কারোলবাগ ছিল চর্ম সংস্কারদের গ্রাম। বেনারস, পাটনা সোনারগাঁ ও ঢাকাতে ছিল তাঁতিদের উপনিবেশ। তবে নগরের অস্তিত্ব বজায় রাখতে ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে প্রয়োজন ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির।
সুতরাং মুঘল যুগের শহর গুলিকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রশাসনিক তথা সামরিক যার মধ্যে পড়ে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক দপ্তর আগ্রা, ফতেপুর সিক্রি, দিল্লি লাহোর, রাজধানী হিসেবে ঢাকা, মুর্শিদাবাদ, বিহার শরীফ ও পাটনা, বুরহানপুর, ফৌজাবাদ। স্বাধীন সুলতানদের রাজধানী হিসেবে আমেদাবাদ, গোলকুন্ডা, হায়দারাবাদ। (২) বাণিজ্যিক যার মধ্যে পড়ে সুরাট, গোয়া, মুসুলিপত্তনাম, সাতগা, হুগলি ও কলকাতা। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে খাতি লাভ করেছিল আমেদাবাদ, মুলতান, বরোদা, আগ্রা, বেনারস, পাটনা প্রভৃতি। ৩) তীর্থস্থান ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে যার মধ্যে পড়ে মথুরা, বেনারস, নাসিক, পুরী, আজমির, তিরুপতি প্রভৃতি। এই শহরগুলি যে শ্রেণীরই হোক না কেন অর্থনৈতিক ভূমিকা ছাড়াও সংস্কৃতিক ভূমিকা ও পালনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
নগরগুলি প্রাচীর বেষ্টিত অথবা প্রাচীরহীন ছিল। নিজামুদ্দিন আহমেদ আকবরের আমলে ১২০ টি বড় এবং ৩২০০ টি শহরের উল্লেখ করেছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ শহর ছিল আগ্রা ও দিল্লি। সপ্তদশ শতাব্দীতে আগ্রার জনসংখ্যা ৫০০০০০(সম্রাটের উপস্থিতিতে ৬০০০০)। শহর জীবনের লোভে বহু গ্রামবাসী শহরে এসে ভিড় করত। বিদেশী পর্যটকরা জানিয়েছেন শহরগুলিতে জনসাধারণ যে কোন পরিষেবা পেতো। সম্ভবত শহর গুলি কোন পৌরসংস্থা দ্বারা চালিত হতো না স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। প্রকৃতপক্ষে নগর গুলির প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব পালন করতো মুৎসুদ্দি, ফৌজাদার, কোতোয়াল, কাজী। কাজী বিচার করতেন, মুনতাসিব বাজার পরিদর্শন ও নৈতিকতা রক্ষার কাজ করতেন। আবুল ফজল বলেছেন এই কোতোয়াল নগর গুলির শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা, দুর্গ গুলির রক্ষণাবেক্ষণ, প্রহরী, আয় ব্যয়ের হিসাব সংগ্রহ বাজারদর নিয়ন্ত্রণ কর কর স্থাপন ও কর আদায় ইত্যাদির দায়-দায়িত্ব পালন করতেন। তবে এ যুগে কোতোয়ালদের শহরবাসীর উপর অর্থনৈতিক উৎপীড়ন করে ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রমাণও মেলে।
তা সত্ত্বেও মুঘল ভারতের নগর জীবনের জৌলুস বিদেশীদের মুগ্ধ করেছে। বিশেষত আগ্রা, দিল্লি ও লাহোরের সৌন্দর্য লন্ডন প্যারিসের সৌন্দর্য কেউ স্নান করে দেয়। নগরের চারিদিকে প্রাচীর। প্রাচীরের গায়ে একাধিক ফটক রাত্রে কোতোয়ালের পাহারা ব্যবস্থা। সমকোণে নির্মিত প্রধান দুটি রাস্তা, রাস্তার পাশে বাজারের সারি। নগরের সুন্দর প্রাসাদে সম্রাটের অবস্থান। এখানকার বাগান সত্যিই প্রশংসনীয়।মুঘল নগরের বাজার দরবারের ঐশ্বর্যের জৌলুস স্যার টমাস রো কে বিমুগ্ধ করেছিল।
শেষত বলা যায় মুঘল যুগে এই নগরায়ন প্রক্রিয়া কিন্তু তার ধারাবাহিকতা বেশিদিন বজায় রাখতে পারেনি। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মুঘল গৌরব অস্তমিত হলে এই মুঘল নগরায়নের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় ও ইউরোপীয় মডেল এ নগর বিন্যাসের সূচনা হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন