মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময়ে মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার দেওয়ান হিসেবে নিজ কর্তৃত্বের সাক্ষ্য রাখেন। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্যের দুর্বলতা ও দলাদলির সুযোগে নিজে ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে থাকে। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি একই সাথে বাংলার দেওয়ান ও সুবাদার পদে নিযুক্ত হন। তিনি কার্যত স্বাধীনভাবেই রাজস্ব চালাতেন। তার ফলে বাংলার ভূমি রাজস্বের ক্ষেত্রে সংস্কার সাধিত হয়। বাংলার শক্তি ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায় এ কথা বলা যায়।
ক্ষমতা আরোহণের পরেই মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার রাজস্ব সংস্কারের কাজে হাত দেন। পূর্ববর্তী রাজস্ব ব্যবস্থায় মুঘল কর্মচারীদের জায়গীর জমি এত বেশি ছিল যে খালিশা জমি না থাকায় ভূমি রাজস্ব বাবদ আয় ছিল কিঞ্চিত মাত্র। মুর্শিদকুলি খাঁ এই অবস্থার মোকাবিলা করতে প্রথমে মুঘল কর্মচারীদের জায়গীর হিসেবে প্রাপ্ত সমস্ত জমি কে খালিশায় পরিণত করেন। এর ফলে খালিশা জমি থেকে রাষ্ট্রের আয় বাড়ে। এইসব জায়গীর হারা কর্মচারীদের উড়িষ্যার অনুন্নত ও জঙ্গল আবৃত অনুর্বর জমিতে নতুন ভাবে জায়গীর দেন। এর ফলে অনাবাদি জমি আবাদিতে পরিণত হবার প্রয়াস দেখা যায়।
রাজস্ব সংস্কারের দ্বিতীয় পদক্ষেপটি ব্যাখ্যা করেছেন স্যার Sir J.N. Sarkar তার History of Bengal voll - ll, গ্রন্থে। তার মতে মুর্শিদকুলি খাঁ জায়গীরদারের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া জমিগুলোতে নিলামের মাধ্যমে ইজারাদার নিয়োগ করেন। একটি চুক্তি পত্রের বিনিময়ে ইজারাদারদের উপর খালিশা জমি গুলি থেকে রাজস্ব আদায়ের পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার মতে এই ব্যবস্থা মাল জামিনী ব্যবস্থা নামে পরিচিত। যদুনাথ সরকার আরো বলেন এই নতুন ব্যবস্থায় জমিদারেরা নতুন ইজারাদারদের অধীনে চলে যায়। এবং ইজারাদারদের দাবি মেটাতে না পেরে এরা অপসৃত হন। এবং ইজারাদারদের বংশধর গণ জমিদার হয়ে ওঠে।
যদুনাথ সরকারের বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন ঐতিহাসিক আব্দুল করিম তার Murshid kuli and his Times গ্রন্থে। তার মতে এনায়েতুল্লাহ খানের আহকাম- ই -আলমগীরী তে বাংলার ভূমি রাজস্বের ক্ষেত্রে মাল যামিনী ব্যবস্থার কথা উল্লেখ থাকলেও তা মুর্শিদকুলির সময় ছিল কিনা তার সঠিকভাবে বলা যায় না। ডঃ রত্নলেখ রায় দেখিয়েছেন এই ব্যবস্থা ওরঙ্গজেবের জীবন দশায় মুর্শিদকুলি খাঁর আমলে প্রচলিত ছিল। সালিম উল্লাহ ও জেমস গ্রান্ট এর দেওয়া তথ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে মুর্শিদকুলি দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজস্ব রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থা ইজারা ব্যবস্থা ছিল কিনা বলা যায় না, তাছাড়া যদি ধরা হয় ইজারা ব্যবস্থা ছিল তাহলেও এ কথা বলা যায় ইজারাদার অবস্থায় সরকারি কর্মচারীদের বেশি কিছু ছিল না। রাজস্ব আদায় করে দেবার জন্য তারা বেতন পেতেন। সর্বোপরি যদুনাথ সরকারের জমিদার ধ্বংসের তত্ব টি আব্দুল করিম অস্বীকার করেছেন। তার মতে বীরভূম, বিষ্ণুপুর, বর্ধমান, নদিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে জমিদার পরিবার গুলি মুর্শিদকুলি কার আমলে বর্তমান ছিল। অধ্যাপক নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ ও বলেছেন মুর্শিদকুলি বড় জমিদারি করে তুলতে উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ে আর বিশ্বস্ত উপদেষ্টা রঘুনন্দন নটোবরের জমিদারি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। তার মতে মুর্শিদকুলির আমলে বাংলার ছয়টি বড় জমিদারি এবং বিহারের তিনটি বড় জমিদারি ছিল সুতরাং আব্দুল করিম ও নরেন্দ্র কৃষ্ণের বক্তব্য থেকে এটা প্রতিফলিত হয় যে মুর্শিদকুলির আমলে জমিদারি ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার পরিবর্তে আরও শক্তিশালী হয়েছিল। আসলে মুর্শিদকুলি খান বৃহৎ জমিদারদের মাধ্যমে রাজস্ব ব্যবস্থা পরিচালনার পক্ষপাতি ছিলেন।
রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে মুর্শিদকুলি কঠোর মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন। কোন জমিদার বা রাজস্ব কর্মচারী সময়মতো রাজস্ব প্রদান করিতে অপারগ হলে তিনি তাদের কঠোর শাস্তি দিতেন। তিনি নির্ধারিত রাজস্ব ব্যতীত অন্য কোন বেআইনি করে নিতেন না। প্রজা স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি আইনি ব্যবস্থা নেন। প্রদেশের সমস্ত জমি আবাদি ও অনাবাদি জরিপ করে জমির উৎপাদিকা শক্তি অনুসারে রাজস্বের পরিমাণ ধার্য করেন। জমি বিবরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৃষকদের নাম ঠিকানা ও রাজস্বের পরিমাণ উল্লেখ থাকত। জমিদাররা এলাকার আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে বা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে মুর্শিদকুলি তার জমিদারি বাজোয়াপ্ত করতেন। বৃহৎ জমিদারেরা যাতে ক্ষমতাবান না হয়ে ওঠে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতেন।
ভূমি রাজস্ব আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থার জন্য মুর্শিদকুলি খান সমগ্র বাংলার 15 টি চাকলায় এবং ১৬৬০ টি পরগানায় ভাগ করেন। প্রত্যেক চাকলায় রাজস্ব আদাই করতেন আমিলরা।
মুর্শিদকুলি ভূমি রাজস্ব সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন রাজস্ব দপ্তরের হিসাব রক্ষকদের পারিশ্রমিক দেওয়ার জন্য বাংলার জমিদারদের উপর কর বসালো। তবে এই কর এর পরিমাণ ছিল খুবই কম। নির্ধারিত রাজস্বের 33% কর আদায় করতেন ফলে এই জমিদারি জমিদারদের লাভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আবার জমিদার নিজের স্বার্থে কৃষকরা যাতে বিদ্রোহ না করে তার জন্য কৃষকদের তাক্কাভি ( ঋণ) দেওয়ার ব্যবস্থা করত। নবাব ,জমিদারি চুত্য জমিদারকে নানাকর নামক ভাতা এবং বনকর ও জলকর এর অধিকার দিত। যদিও গোলাম হোসেন বলেছেন কেবল যেসব জমিদার রাজস্ব প্রদানে গাফলতি করত তাদেরকেই জমি জরিপ করা হতো।
মুর্শিদকুলি খানের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা বাংলার গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। এক দিকে নতুন ভূস্বামী শ্রেণী হিসাবে ইজারাদারদের উত্থান ঘটেছিল আবার অন্যদিকে জমিদারি ব্যবস্থা ও শক্তিশালী হয়েছিল। নতুন রাজস্ব ব্যবস্থায় সরকারের আয় বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় বাংলায় তার আমলে আদায়কৃত ভূমি রাজস্ব প্রায় দেড় কোটি হয়েছিল। ফলে বাংলার কোষাগার সমৃদ্ধ হয় পরোক্ষভাবে মুঘল সম্রাটরাও।
কেউ কেউ মুর্শিদকুলির রাজস্ব ব্যবস্থাকে উৎপীড়ন মূলক ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু দেখা যায় যে দরিদ্র কৃষকদের জন্য তাক্কাভি ঋণের ব্যবস্থা ছিল। অতি বৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি তে রাজস্ব মকুভ করা হতো। তাছাড়া ভূমি রাজস্ব ব্যথিত অন্য কোন প্রকার কর কৃষকদের কাছ থেকে নেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। মুর্শিদকুলি খানের মদতে রায়তদের উপর জমিদারদের অত্যাচারের কোন ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ মিলেনি। তার ফলে ১৭১১ খ্রিস্টাব্দে ছাড়া দুর্ভিক্ষ হয়নি তবে বাংলার মুদ্রা সংকটের জন্য কৃষকদের দুর্দশার কথা আব্দুল করিম স্বীকার করেছেন। তবে মুর্শিদকুলি খাঁ সর্বদাই কৃষক স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করতেন এ কথা অনস্বীকার্য।
মোটের উপর বলা যায় মুর্শিদ কুলি খানের রাজস্ব ব্যবস্থা ছিল একটি প্রয়োজন ভিত্তিক একটি ব্যবস্থা। না ছিল ইজারাদারি না ছিল রায়তওয়ারী এতে কৃষকদের উন্নয়নের চেষ্টাও হয়েছিল। তবে কৃষকদের আর্থিক সমৃদ্ধি কতটা হয়েছিল তা বলা শক্ত। আমির খসরুর মন্তব্য ছিল সম্রাটের রাজ মুকুটে যে মুক্ত গুলো জ্বলজ্বল করছে তা কৃষকদের চোখের জলের কেলাসিত রূপ। এই চির প্রযোজ্য বাণী এক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছিল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন