কেন লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেছিল? বাংলার আর্থসামাজিক জীবনে এর প্রভাব পড়েছিল?
১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় দেওয়ানী লাভের অধিকার পাওয়ার পর থেকে একের পর এক ভূমি রাজস্ব আদায় সম্পর্কিত জটিলতা দেখা দেয়। হেস্টিংস প্রবর্তিত ইজরাদারি ব্যবস্থায় নানা ত্রুটি থাকায় কর্নওয়ালিস জমিদারদের সাথে চিরস্থায়ী ভাবে বন্দোবস্ত করেন। বাংলার আর্থসামাজিক জীবনে এর প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ।
হেস্টিংস প্রবর্তিত ইজারাদারী ব্যবস্থায় জমি প্রতিবছর নিলামের মাধ্যমে ইজারা দেওয়া হত। প্রতিবছর ইজারাদার বদলাবার সম্ভাবনা থাকায় ইজারাদাররা কৃষির উন্নতিতে নজর দিত না। যত বেশি সম্ভব আয়ের জন্য কৃষকদের উপর জুলুম করতো কৃষকরা তাই অনেক সময় পালিয়ে যেত। কৃষি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হত। প্রতিবছর নিলাম হওয়ায় কোম্পানির আয়ের নিশ্চয়তা ছিল না। কখনো কখনো ইজারাদারা প্রতিশ্রুত অর্থ মেটাতে পারত না।
উপরোক্ত কারণে কর্নওয়ালিসকে ভূমি বন্দোবস্ত সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হয়। জমিদার বংশের সন্তান কর্নওয়ালিস ইংল্যান্ডের অনুকরণে জমিদারদের সাথে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চাইতেন। কর্নওয়ালিসের ভারতে আসার আগেই বস্তুত ১৭৭০ থেকে আলেকজান্ডার ডাফ, ফিলিপ ফ্রান্সিস, টমাস রো মতো ইউরোপীয় পর্যবেক্ষণ ও কোম্পানির অধিকারীরা, যারা মোটামুটি ফিজিওক্রাটিক ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন জমির খাজনা স্থায়ী করার কথা বলে আসছিলেন। এসব ধারণা নিয়েই কর্নওয়ালিস 1779 খ্রিস্টাব্দে জমিদারদের সঙ্গে দশশালা বন্দোবস্ত করেন এবং ঠিক হয় কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরএর অনুমোদন পাওয়া গেলে দশশালা ব্যবস্থা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পরিণত করা হবে।
এ প্রসঙ্গে শোর গ্র্যান্ট বিতর্ক উল্লেখযোগ্য। রাজস্ব বিভাগের প্রধান জন শোর ১০ বছর পরেও এই ব্যবস্থা বহাল রাখার ব্যাপারে আপত্তি করেন। দলিল বিভাগের প্রধান জেমস গ্রান্ট জমির মালিকানা কৃষকদের দেওয়ার ব্যাপারে জোরালো মত দেন।
অনেক আলাপ আলোচনার পর ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টর এর অনুমোদন পাওয়া গেলে বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সচিব ডান্ডাসের সহযোগিতায় কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে ২২ শে মার্চ দশশালা বন্দোবস্ত কে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রূপান্তরিত করেন। এই ব্যবস্থায় জমিদারদের বংশানুক্রমিক ও হস্তান্তরযোগ্য জমির মালিকানা দেওয়া হয়। তবে বলা হয় নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিশ্রুত রাজস্বের অর্থ মেটাতে না পারলে তার জমিদারি বাজোয়াপ্ত করা হবে।
ঠিক হয় ১৭৮৯ থেকে ১৭৯০ পর্যন্ত আদায়কৃত মোট রাজস্বের ৭/১০ ভাগ হারে চিরস্থায়ীভাবে জমিদাররা সরকারকে রাজস্ব দেবে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। আর পি দত্ত তার 'Indian Today' গ্রন্থে বলেছেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে কোম্পানি তাদের অনুগত মিত্র গড়তে চেয়েছিলেন। ক্রমবর্ধমান কৃষক অসন্তোষ এর দিনে জমিদার রাই বিদ্রোহ দমনের অস্ত্র হিসেবে কাজে আসবে তাই। অন্যদিকে বিনয় ভূষণ চৌধুরীর মতে সে সময়ে গণবিদ্রোহ জনিত সমস্যার কোন অস্তিত্ব ছিল না। তবে কর্নওয়ালিসের কথা আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এদেশে ভূস্বামীদের আমাদের সহযোগিতা করে নিতে হবে। দ্বিতীয়ত কোম্পানির কর্তৃপক্ষ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে রাজস্বের পরিমাণ সম্পর্কে স্থিতিশীল ও নিশ্চিত ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলেন। তৃতীয়ত ইংল্যান্ডের মতো ভারতের জমিদারও কৃষি সম্প্রসারণ ঘটাবে এমন আশা করা হয়েছিল। চতুর্থ অসংখ্য রায়তদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের চেয়ে কয়েকজন জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্ব আদাই অনেক বেশি সস্তা ও সরল। পঞ্চমত বিখ্যাত পন্ডিত অশোক মিত্র বলেছেন চিরস্থায়ী ব্যবস্থার মাধ্যমে কোম্পানি ভারতকে একটি কৃষি নির্ভর দেশ হিসাবে বেঁধে দিতে চেয়েছিলেন। যাতে ইংল্যান্ডের শিল্প জাত পণ্য আমদানি ভারতে সহজ হবে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কোম্পানির রাজস্বের পরিমাণকে নিশ্চিত করেছিল ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীকালে রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনা আর ছিল না। এই ব্যবস্থায় কোম্পানির অনুগত এক সামন্ততান্ত্রিক জমিদার শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছিল। 19 শতকের বাংলায় সশস্ত্র বিদ্রোহ প্রতিরোধে এই জমিদার রাই ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রধান স্তম্ভ হিসেবেই বিদ্রোহ দমনের ক্ষেত্রে প্রদান ভূমিকা নিয়েছিল।
বন্দোবস্তটি যতই জমিদার ঘেঁষা হোক না কেন জমিদারদেরও বেশ কিছু অসুবিধার মুখে পড়তে হয়েছিল। ড্যানিয়েল থরনার দেখিয়েছেন যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির ব্যাপারটা ভ্রান্ত আসলে জমির চূড়ান্ত মালিকানা ছিল সাম্রাজ্যের কর্তৃপক্ষের হাতে। একটি নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে জমিদারদের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ যে খাজনা কোম্পানিকে দিতে হতো, আর দিতে না পারলে জমিদারি সম্পত্তি বিক্রি করে মেটাতে হতো। জমিদারদের পক্ষেও রাজস্ব আদাই করা কঠিন হয়ে পড়তো। কারণ ধার্য রাজস্বের পরিমাণ ছিল অনেক বেশি এবং এর সাথে ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তাই পরিনামে জমিদারি সম্পত্তির প্রায় বিক্রয় হয়ে যেত। 1794 থেকে 1807 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলা ও বিহারে যে পরিমাণ জমি নিলামে বিক্রি হয় তার ধার্য রাজস্বের পরিমাণ ছিল মোট রাজস্বের ৪১% আর উড়িষ্যায় ১৮০৪ থেকে ১৮০৮ এর মধ্যে ৫১ শতাংশ জমিদারি নিলামের কারণেই উঠে যায়।
উল্টোদিকে যারা এইসব জমিদারি কিনত তারা বাংলার কৃষি প্রদান সমাজে একেবারে নতুন লোক ছিল না। জমিদারদের আধিকারিকরা ধনী প্রজা অথবা প্রতিবেশী কোন পুরানো জমিদার গুলিকে নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে নিত, যেমন বর্ধমানের ক্ষেত্রে দেখা যায়। এই জমিদারি তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে "পত্তনী" ব্যবস্থা চালু করে, জমিদার ও কৃষকের মাঝে কখনো কখনো বারো রকমের পত্তনীদার বা মধ্যস্বত্বভোগীদের দেখা যেত। এর ফলে খাজনার চাপ বেড়ে যেত এবং তা কৃষকের উপরেই গিয়ে পড়তো।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তায় কৃষক সমাজই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল। জমিদার ও কৃষকের মধ্যে লিখিত চুক্তি থাকতো একে বলা হয় পাট্টা ব্যবস্থা। ১৭৯৯ এবং ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে দুটি আইন পাস হয় যেখানে বলা হয় কৃষক তার খাজনা দিতে না পারলে, জমিদার তার সম্পত্তি আদালতের অনুমতি ছাড়াই অধিগ্রহণ করতে পারবে। এভাবে কৃষকদের জমি ভোগ দখলের পুরানো ঐতিহ্যগত অধিকার কে উপেক্ষা করে প্রজার পর্যায়ে ঠেলে দেওয়া হল। যদিও ১৮৫৯ ও ও ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানিরাজ নিজ আত্মশক্তিতে ভরপুর একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। তখন প্রজাসত্ব আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কৃষক প্রজাদের কিছুটা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
নতুন আইন সংস্কারের ফলে গরিব চাষীদের কোন সুরাহা হয়নি বরং একদল ধনী কৃষক, জোতদারদের হাত শক্ত হয়, রজত রায় এবং রত্ন লেখা রায় এরকমই মনে করেন। অন্যদিকে সুগত বসু তার বইয়ে জোতদার ভাবনাকে বিরূপ সমালোচনা করেছেন। তার মতে জোরদার দের অধিপত্য কেবলমাত্র উত্তরবঙ্গেই সীমাবদ্ধ ছিল। পূর্ব বাংলায় ছিল কৃষকদের ছোট ছোট জমিতে চাষের প্রথা। এই দুটি অংশেই ১৮৩০ পর্যন্ত জমিদারদের ক্ষমতা অব্যাহত ছিল। রাজত রায় পরবর্তীকালে একটি নিবন্ধে এই কথা স্বীকার করে জোরদার ভাবনার পক্ষে বলেন যে ১৮৩০ এর দশক পর্যন্ত বাংলায় গ্রামে জমিদারদের কর্তৃত্ব হয়তো কিছুটাও বজায় ছিল তবুও গ্রামেগঞ্জে সম্পন্ন চাষীরা প্রভাবশালী ছিলেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন