নবাব আলীবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র সিরাজ উদ দৌলা বাংলার মসনদে বসেন। তারপর কয়েকটি বিষয়কে কেন্দ্র করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে বাংলার নবাবের বিরোধ শুরু হয়। এই বিরোধ কালক্রমে পলাশীর যুদ্ধে পরিণতি লাভ করে। বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম।
১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে সিরাজের সিংহাসন আরোহন অনেকের মনঃপুত হয়নি। যদিও আলীবর্দী সিরাজকেই মনোনীত করেছিল। আলীবর্দীর অপর এক দৌহিত্র পূর্ণিয়ার ফৌজদার 'সওকত জঙ্গ' বাংলার মসনদের প্রতি লালিত ছিল, সিরাজের মাসি 'ঘাসেটি বেগমও' তাই। আলীবর্দী র মীর বকশি 'মীরজাফর' সিরাজের বিরোধী ছিলেন।
ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের প্রথম দিকে ভালো সম্পর্কই ছিল। যদিও সিরাজ যখন সিংহাসনে বসেছিল চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী সবাই আনুগত্যের নিদর্শন স্বরূপ নজরানা পাঠালেও ইংরেজরা পাঠাইনি। সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের প্রথম দিকের বিরোধের সূচনা হয় কৃষ্ণদাসকে কেন্দ্র করে। ঢাকার জায়গীরদার রাজবল্লবের পুত্র, কৃষ্ণদাস প্রচুর সম্পত্তি নিয়ে কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির আশ্রয় গ্রহণ করে। রাজবল্লভও ছিলেন ঘাসেটি বেগমের ঘনিষ্ঠ। কৃষ্ণ দাস কে নবাবের হাতে তুলে দেওয়ার চিঠি পাঠালে ইংরেজরা তাও অমান্য করে। ফলে সিরাজ সহজেই বুঝে যায় ঘাসেটি বেগম, সওকত জঙ্গদের সঙ্গে ইংরেজরা যুক্ত রয়েছে।
সিরাজ সিংহাসনে বসে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। ঘাসেটি বেগমের সম্পত্তি বায়োজাপ্ত করেন। মীরজাফরকে মীর বকশি পথ থেকে সরিয়ে মীর মদনকে নিয়োগ করেন। আলীবর্দীর সময়কার প্রভাবশালী রাজ পুরুষেদের অনেককেই তাড়িয়ে দেন। গোলাম হোসেনের লেখা থেকে জানা যায় আলীবর্দীর সময়কার অনেক পদাধিকারী এ সময় সিরাজের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। দেওয়ান রায়দুর্লভ পশ্চিমবঙ্গে জমিদারদের সংগঠিত করেন। বর্ধমান, নদীয়া, বীরভূমের জমিদাররা সিরাজের বিরুদ্ধে চলে যায়। বাংলায় অত্যন্ত ধনী মহাজন জগৎ শেঠ ছিলেন অনুরুপ।
১৭৫৭ সালের গোড়াতেই বাংলার অভিজাতন্ত্রের একটা উদ্দেশ্য ছিল, যেভাবেই হোক সিরাজকে তাড়ানো। ইতিমধ্যেই সিরাজ উদ দৌলার সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধিতা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছিল। ১৭১৭ সালের ফরমান অনুযায়ী ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফারুকশিয়ারের কাছ থেকে বাংলাদেশে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার পেয়েছিল। ইংরেজ কর্মচারী তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য শুল্কে ফাঁকি দিচ্ছে দস্তকের অপব্যবহার করে। অফুরন্ত ভারতীয় পণ্য যখন তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন কলকাতায় প্রবেশ করতে লাগল তখন সেইসব পণ্যের উপর ইংরেজ কোম্পানি শুল্ক ধার্য করতো। তারপর ইংরেজ কোম্পানির সহযোগিতায় এশিয়ান বণিকরাও দস্তকের অপব্যবহারের সুযোগ নিয়ে বাণিজ্য শুল্ক ফাঁকি দিতে লাগলো এই অবস্থায় সিরাজের পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হওয়ায় স্বাভাবিক।
প্রথমদিকে সিরাজ একটি সমঝোতায় আসতে চেয়েছিল এবং এর জন্যই একটি চিঠি পাঠিয়েছিল। ইংরেজরা যদি এদেশে থাকতে চায় তাহলে মুর্শিদকুলি খানের যাবতীয় শর্ত মেনে নিয়ে বাংলাদেশে বাণিজ্য করতে হবে। কিন্তু এর উপর আরেকটি ঘটনা সিরাজ ইংরেজ সম্পর্ককে আরও তিক্ত করে। ইংরেজরা নবাবের অনুমতি ছাড়াই কলকাতা একটি দুর্গ নির্মাণ করতে শুরু করেছে। যা সিরাজের সার্বভৌমত্বের উপার হস্তক্ষেপ বলে মনে হয়। তবুও সিরাজ আলোচনার পথে যেতে দূত নারায়ন দাস কে কলকাতায় পাঠান ইংরেজরা তাকে অপমানিত করে।
এই অবস্থায় সিরাজ কঠোর পদক্ষেপ নিতে মনস্থ করেন। কাশিমবাজার আক্রমণ করে তিনি কলকাতা দখল করেন। কলকাতার গভর্নর ড্রেক তার অনুচরদের নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর সওকত জঙ্গ কে দমন করার জন্য পূর্ণিয়ার অভিমুখে যাত্রা করেন। সওকত জঙ্গ পরাস্ত হন।
সিরাজের এই সাফল্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, মাদ্রাজ থেকে সাহায্য আসার পর ইংরেজরা ক্লাইভের নেতৃত্বে ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা পুঃন দখল করে এবং সিরাজের সঙ্গে আলিনগড়ের সন্ধি হয়। সন্ধির শর্তানুসারে সিরাজ ইংরেজদের ক্ষতিপূরণ ফ্যাক্টরি ও বাণিজ্যিক অধিকার গুলি ফিরিয়ে দিলেন। কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ ও টাকা তৈরীর অধিকার দেয়। আলিন গড়ের সন্ধির পর থেকে ইংরেজ কোম্পানির একটিমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সিরাজকে ক্ষমতাচ্যুত করা। তাই জগৎ শেঠ ও অন্যান্যদের তৈরি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ইংরেজরা মিলে যায়।
পলাশীর ষড়যন্ত্র নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। ব্রিজেন গুপ্ত মনে করেন জগৎ শেঠ ও তার অনুগামীদের সিরাজ বিরোধী ষড়যন্ত্র ছিল, তৎকালীন হিন্দু সমাজের স্বৈরতান্ত্রিক মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল ফলশ্রুতি। সি এ বেলি মনে করেন হিন্দু বাণিজ্যিক শ্রেণী কর্তৃক পলাশীর বিপ্লব পরিচালিত হয়েছিল। বাংলা থেকে ইংরেজরা বিতাড়িত হোক এটা তারা চাইনি কারণ তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ কোম্পানির সাথে দৃঢ়ভাবে জড়িত ছিল। অধ্যাপক কে এন চৌধুরী ও ওম প্রকাশ বাণিজ্যিক ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন ১৭৪০ সাল থেকে জগৎ শেঠ সহ অন্যান্য ভারতীয় বণিকদের সঙ্গে বাণিজ্য অত্যন্ত লাভজনক হয়েছিল।
অন্যদিকে সুশীল চৌধুরী এবং শিরিন মুসভি সম্প্রতিক গবেষণায় উপরিক্ত মতটি খারিচ করে দিয়েছেন। প্রথমত কেবলমাত্র ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ভারতের বুলিয়ান আমদানি করত না এমনকি তারা বৃহৎ বুলিয়ান আমদানিকারী ছিল না। দ্বিতীয়ত পরিসংখ্যান বলে বাংলায় তখন আর্মেনীয় বণিকসহ এশিয়ান বণিকদের বাণিজ্যের পরিমাণ ইউরোপীয় বণিকদের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। তৃতীয়তঃ জগৎ শেঠ, উমি চাঁদ, খাজা ওমাজিদ এই তিনজন বনিকের আয়ের উৎস ইউরোপীয়দের সঙ্গে ব্যবসা থেকে উপার্জনের চেয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন জগৎ শেঠের মুদ্রা তৈরি ও সুদের ব্যবসা বেশি লাভজনক ছিল।
সিরাজ বিরোধী স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ক্যামব্রিজ ঐতিহাসিকেরা জোরের সঙ্গেই বলেছেন এটি মূলত হিন্দুদের মুসলিম বিরোধী ষড়যন্ত্র। ইংরেজরা ঘটনারচক্রে এই ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছিল। এই ধরনের মতামত যে সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আড়াল করারই চেষ্টা। সুশীল চৌধুরী দেখিয়েছেন তাছাড়া এটি শুধু হিন্দুর ষড়যন্ত্র হিসেবেও দেখা যাবে না। আর্মেনীয় ও মুসলমান বণিকরাও এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে ইংরেজ কোম্পানি সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের দ্বারা তারিত হয়ে সিরাজের বিরুদ্ধ চারণ করেছিল। একই সাথে সিরাজের উচ্চাভিলাশি আত্মীয়-স্বজন, বাংলার ধনী বণিক ও মহাজনেরা এবং জমিদাররা সিরাজবিরোধী ষড়যন্ত্র আরম্ভ করে। উভয়ই সাধারণ উদ্দেশ্য এক নবাব কে সরানো তাই একটি বোঝাপড়া হয়। সিরাজ জানতে পারলেও কোন পদক্ষেপ না নিয়ে আবার মীরজাফরকেই মীর বকশি পদে বসান। ১৭৫৭ সালে ১৩ ই জুন ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা করে। এবং ২২শে জুন উভয় পক্ষের যুদ্ধ হয় নবাবের বাহিনী পরাজিত হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন