সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা বা নায়ক ব্যবস্থা অথবা নয়ঙ্কারা ব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা কর?

 বিজয়নগর রাজ্যের সামরিক ব্যবস্থা ও ভূমিদান রীতির সাথে বিশেষভাবে জড়িত ছিল নায়ক বা নয়ঙ্কারা প্রথা। ‌ সংস্কৃত সাহিত্য 'নায়ক' অর্থে নেতা বা বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। কিন্তু বিজয়নগরের নায়ক প্রথা কিছুটা স্বতন্ত্র। নায়কদের অধিকার কর্তব্য, নায়ক প্রথার প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। অধ্যাপক অনিরুদ্ধ রায়ের মতে বিজয়নগরের নায়করা স্থানীয় নেতৃবর্গের থেকে স্বাধীন। বিজয় নগরের বিভিন্ন শিলালেখতে "অমরয়ঙ্কর" শব্দটি পাওয়া যায়। এখানে 'অমর' শব্দের অর্থ সৈন্যধাক্ষ, "নায়ক" অর্থে নেতা এবং 'কর' বলতে সরকারি কাজকে বোঝানো হয়েছে। এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নায়ক প্রথার বৈশিষ্ট্য গুলো অনুধাবন করা যায়।


অধ্যাপক নীলকন্ঠ শাস্ত্রী বলেন বিজয়নগর একটি 'যোদ্ধা রাজ্য' বা 'war state' এবং এই সাম্রাজ্যের গঠন তার সামরিক প্রয়োজনেই গড়ে উঠেছে। তার মতে বিজয়নগর সাম্রাজ্য ছিল অসংখ্য সামরিক নেতার মিলিত প্রয়াসের ফল। টি. ভি. মহালিঙ্গম বলেছেন বিজয় নগরের অভ্যন্তরীণ সংগঠনের প্রধান ভিত্তি ছিল নয়নঙ্কারা ব্যবস্থা। এই প্রথা অনুযায়ী রাজা নায়কদের হাতে ভূমি রাজস্বের অধিকার অর্পণ করতেন। নায়করা একাধারে ছিলেন সামরিক নেতা, স্থানীয় প্রশাসক। এছাড়া ও তারা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের আদায়কৃত রাজস্বের একাংশ কেন্দ্রীয় কোষাগারে জমা দিতেন। তামিল দেশে ১৫ শতকের শেষ ভাগে ও ষোড়শ শতকের গোড়ায় নায়ক প্রথার ব্যাপকতা দেখা দেয়। তামিল এলাকার অধিকাংশ নায়ক ছিলেন বহিরাগত তেলেগু যোদ্ধা। 


সমকালীন স্থানীয় লেখমালা এবং বিদেশী এবং বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ থেকে বিজয়নগরের দুর্গ ও দুর্গাধিপতির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি পাওয়া যায়। সমকালীন তেলেগু কবিতায় দেখানো হয়েছে বিজয়নগরের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণদেব রায়, ব্রাহ্মণ, সামরিক নেতা ও বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রশক্তির বৃদ্ধির কথা বলেছেন। চোলদের আমলে প্রচলিত ব্যবস্থার‌ই  সম্প্রসারিত ও প্রবর্তিত প্রথা হিসেবে সামরিক নেতৃত্বের কাজে ব্রাহ্মণদের উত্থান ঘটে। বিজয়নগরে এদের সরাসরি ও দুর্গের অধ্যক্ষ নিয়োগ করে সামরিক নেতৃত্বের অংশীদারে পরিণত করা হয়। এছাড়া স্থানীয় ব্রাহ্মণদের পাশাপাশি মহারাষ্ট্র থেকেও বহু ব্রাহ্মণ এসে সামরিক নেতৃত্বের কাজে লিপ্ত হন। 


বিজয়নগরের এই রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা সে দেশের কৃষি সম্পর্কের উপরে ও প্রভাব ফেলে। ঐতিহাসিক বেঙ্কটরামনাইয়া  প্রমুখ ঐতিহাসিকরা মনে করেন বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা দক্ষিণ ভারতের সমাজ ও সংস্কৃতিতে লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটাতে পারিনি। মুসলমান অগ্রগতির মুখে হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন রীতিনীতি কে কঠোরভাবে আঁকড়ে থাকার প্রবণতা ছিল বলে মনে করেন। ঐতিহাসিক নীলকন্ঠ শাস্ত্রী এই আদর্শবাদের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েও বিজয়নগরের সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তনের দিকটি তুলে ধরেছেন। তার মতে চোল আমলে জনপ্রিয় সভা, উর, নাড়ু,ইত্যাদির অস্তিত্ব বিজয়নগর আমলে শিথিল হতে থাকে এবং কালক্রমে বিলোপ ঘটে। এই পুরানো ব্যবস্থা গুলির স্থান নিয়েছিল নয়ঙ্কারা ও আয়গার প্রথা। তাঁর মতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের অধীনে আসার পর তামিল দেশে আয়গার প্রথার আবির্ভাব ঘটে, এই প্রথার মাধ্যমে গ্রামীণ কর্মচারীদের জমি বন্দোবস্ত দেওয়া হত। 


নয়ঙ্কারা প্রথা উদ্ভবের সাথে সাথে বিজয়নগর  রাজ্যের রাষ্ট্রনৈতিক চরিত্র এবং সামন্ততন্ত্রের সাথে এই প্রথার সামঞ্জস্যের বিষয়টি ঐতিহাসিক  বিতর্কের কেন্দ্রে  চলে এসেছে । তবে বিজয়নগরের 'নায়ক' প্রথাকে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে একীভূত করা সঠিক নয়। কারণ বিজয় নগরের 'নায়ক' এমন একজন যোদ্ধা যে রাজ্যের সামরিক ব্যবস্থার অঙ্গ এবং সে সবসময় তার নিজের অধিকারের একজন স্থানীয় জমিদার। পর্যটক নুনিজ ২০০ জন নায়কের সন্ধান পেয়েছেন এবং তিনি কোন ইঙ্গিত দেননি যে বিজয়নগর বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনের পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিল।


বার্টন স্টেইন লিখেছেন মধ্যযুগীয় দক্ষিণ ভারতীয় রাজনীতি অনুসারে বিজয়নগর রাজ্য ছিল Segmentary স্টেট বা একাধিক অংশের সমন্বয়। বিজয়নগর কে একটি বৃহৎ এলাকা বা Macro region হিসেবে চিহ্নিত করলেও বিজয়নগরের রাজা কার্যত একটি ছোট এলাকা বা Micro region কে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। রাজ্যের অবশিষ্ট অংশের আঞ্চলিক শাসকরা 'নায়ক' রাজার প্রতি আনুগত্য দেখালেও তারা স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করতেন এই খান্ডিত অংশগুলি সম্মিলিতভাবে বিজয়নগরের সামগ্রিক রাজ্য সৃষ্টি করেছিল। 


তেলেগু ও কন্নড়ভাষীরা বিজিত এলাকাগুলোতে গিয়ে পূর্বাতন অধিবাসীদের উৎখাত করেছিল তেমন সে তথ্য পাওয়া যায় না। তারা সাধারণভাবে আয়গার ব্যবস্থার মাধ্যমে বিজিতদের শ্রমকে কাজে লাগিয়ে এবং যাবতীয় উদ্বৃত্ত কেন্দ্রে পাঠায়। এইভাবে গড়ে ওঠা গ্রামগুলির শ্রেণীবিন্যাস হয়। ভান্ডারবড়া অর্থাৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল যেগুলি স্থানীয় কেল্লার রসদ যোগাত । নিষ্কর 'মান্য' যেগুলি দেবস্থান ও ব্রাহ্মণ প্রভৃতির রসদ যোগাত। 'অন্যরম' এলাকা যেগুলি নায়কদের হাতে ছিল। 


এভাবেই জমির স্বত্ব হস্তান্তরিত না করে জমির উৎপাদনের স্বত্ব হস্তান্তরিত হয়েছিল। উদ্বৃত্ত বন্টনের কাঠামো সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ডঃ কৃষ্ণস্বামী 'মান্য' কে আয়গার শ্রেণীর ভরণপোষণের একক হিসেবে গণ্য করেছেন। আয়গার বলতে প্রশাসনিক কর্মচারীকেই আর বোঝালো না ধীরে ধীরে এই শ্রেণীর মধ্যে এমন কিছু শ্রমজীবীকে অন্তর্ভুক্ত করা হলো যারা পরোক্ষভাবে কৃষি কাজের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। 


ডঃ বার্টন স্টেইনের মতে নায়কদের হাতে জমির কেন্দ্রীকরণ ঘটলেও বিজয়নগরের ব্যবস্থাকে ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের সমতুল্য বলা চলে না। বিজয় নগরের ৭৫ শতাংশ জমি বিভিন্ন নায়ক দের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই ব্যবস্থা জাপানের সামন্ততন্ত্রের কিছুটা কাছাকাছি তবে এক্ষেত্রেও স্পষ্ট প্রভেদ লক্ষণীয়ৃ জাপানের সামন্তরা উপর ও নিচে অনেকগুলি আর্থ -সামাজিক স্তরবিন্যাস ছিল। অন্যদিকে বিজয় নগরের নায়করা প্রত্যক্ষভাবে জমি নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং এখানে কোন স্বীকৃত মধ্যবর্তীর অস্তিত্ব ছিলনা এই বিচারে বিজয়নগর কে একটি 'যুদ্ধরাষ্ট্র' বলা যায়, সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...