সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

চোল রাজাদের বাণিজ্য নীতি | The Trade Policy of the Chola Kings

চোল রাজাদের বাণিজ্য নীতি

আদিমধ্য যুগে দক্ষিণ ভারতে বাণিজ্যে, বিশেষ করে মহাসাগরীয় বাণিজ্যে চোল রাজারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। দুই মহান চোল রাজা রাজরাজ ও রাজেন্দ্র চোলের যোগ্য তত্ত্বাবধানে ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্যে আরব বণিকদের প্রভাব ক্ষুন্ন করে নিজেদেরকে দেশীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল। 

রাজরাজের সময় করমন্ডল উপকূল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সাথে বাণিজ্যের প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয়। প্রথমদিকে মামল্লপুরম বন্দরের গুরুত্ব ছিল। নেগপত্তনমের উত্থান মামল্লপুরমের গুরুত্ব হ্রাস পায়। চোল রাজা রাজরাজ চীনে দূত পাঠান। চোলরা রাজারা নৌ-বাণিজ্যে আরবদের প্রভাব ক্ষুন্ন করতে উদ্যোগী হন। রোমিল থাপারের মতে এজন্যই পান্ড্য ও কেরল রাজ্য আক্রমণ করেন। কেরল জয় করে সেখানে আরব বণিকদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করে দেন। তিনি মালদ্বীপ দখল করেন। লাক্ষাদ্বীপ দখল করেন, সিংহল আক্রমণ করে অর্ধেকটা জয় করেন। এগুলি সবই ছিল আরব বণিকদের বাণিজ্যের ঘাঁটি। 

রাজরাজের পুত্র রাজেন্দ্র চোলও ওই একই নীতি গ্রহণ করেন। সিংহল জয়ের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রীবিজয় নামক স্বাধীন রাজ্যটি দক্ষিণ ভারত ও চীনের একটি অন্তবর্তী ঘাঁটি। শ্রীবিজয় এর সাথে প্রথম দিকে চোলদের সুসম্পর্ক ছিল। চীন বাণিজ্যই ছিল শ্রীবিজয় রাজ্য আক্রমণের মূল কারণ। চীন সম্রাটরা দক্ষিণ ভারতের সাথে বাণিজ্যের আগ্রহ দেখায়। চোল রাজ্য থেকে একটি বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক মিশন চিনে যায়। রোমিলা থাপার মনে করেন চীন বাণিজ্যে শ্রীবিজয় রাজ্যের মধ্যস্থতার ভূমিকাকে খর্ব করতেই রাজেন্দ্র চোল ওই রাজ্যটি আক্রমণ করে এবং বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন।

পরবর্তী চোল রাজারাও বাণিজ্যিক গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। চোল রাজা কুলোতুঙ্গা বিদেশি বণিকদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য শুল্ক তুলে দেওয়ার কথা বলেন। ব্রহ্মদেশের (পাগান) রাজার সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। ব্রহ্মদেশ ছিল চীন ও চোল বাণিজ্যের মধ্যবর্তী মাধ্যম। তাঁর সময়েই বেঙ্গি উপকূলে বিশাখাপত্তনম (কুলোতুঙ্গা চোলপট্টনম) বন্দরের উত্থান ঘটে। কুলোতুঙ্গার সময় শ্রীবিজয় রাজ্যের সাথে আবার সৌহার্য স্থাপিত হয়।

চোল রাজারা কেবল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির উপর নির্ভর না করে বাণিজ্যিক সম্প্রসারণে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তারা আরবদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ভারত মহাসাগরে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেন, কৌশলী উপনিবেশ স্থাপন করেন এবং সফলভাবে সামুদ্রিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে আনেন। বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে চোল শাসকরা যে কূটনৈতিক সম্পর্ক, সামরিক অভিযান ও বন্দর উন্নয়ন করেছিলেন, তা মধ্যযুগীয় দক্ষিণ ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক অসাধারণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। 

The Trade Policy of the Chola Kings

In early medieval South India, the Chola rulers played a significant role in trade, especially in maritime commerce. Under the capable leadership of two great Chola kings, Rajaraja and Rajendra Chola, the Cholas were able to diminish the influence of Arab merchants in the Indian Ocean trade and establish indigenous dominance.

During Rajaraja’s reign, the Coromandel Coast became a major hub for trade with Southeast Asia and China. Initially, the port of Mamallapuram held great importance, but with the rise of Nagapattinam, Mamallapuram’s prominence declined. King Rajaraja Chola sent an envoy to China. The Chola rulers took active steps to undermine the influence of Arab traders in maritime commerce. According to historian Romila Thapar, this was the reason behind Rajaraja’s campaigns against the Pandya and Kerala kingdoms. After conquering Kerala, he prevented Arab merchants from entering the region. He also seized the Maldives, Lakshadweep, and partially conquered Sri Lanka—regions that were all significant trading posts for Arab merchants.

Rajaraja’s son, Rajendra Chola, continued this same policy. He completed the unfinished conquest of Sri Lanka. The independent kingdom of Srivijaya in Southeast Asia was an intermediary hub between South India and China. Initially, the Cholas had friendly relations with Srivijaya. However, the principal reason behind the attack on Srivijaya was trade with China. The Chinese emperors expressed interest in direct trade with South India, and a commercial and diplomatic mission was sent from the Chola kingdom to China. Romila Thapar opines that Rajendra Chola attacked Srivijaya and forced it into submission in order to diminish its role as a middleman in Chinese trade.

Later Chola kings were also aware of the importance of commerce. King Kulottunga Chola proposed the abolition of customs duties to encourage foreign merchants. He maintained good relations with the king of Burma (Pagan), who served as a crucial intermediary between Chinese and Chola trade. During his reign, the port of Visakhapatnam (then called Kulottunga Cholapattinam) on the eastern coast of India rose in importance. During Kulottunga’s time, cordial relations with Srivijaya were reestablished.

Thus, the Chola rulers did not rely solely on an agriculture-based economy but prioritized commercial expansion. They established their presence in the Indian Ocean as strong rivals to the Arabs, engaged in strategic colonial activities, and successfully controlled maritime trade. The diplomatic relations, military expeditions, and port development undertaken by the Chola rulers around trade stand out as a remarkable chapter in the economic history of medieval South India.

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...