আদি মধ্যযুগের অর্থনৈতিক ইতিহাসে দেশীয় বাণিজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও ডঃ শর্মা ও যাদব এযুগের অর্থনৈতিক অবক্ষয় ও বদ্ধ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির তথ্য তুলে ধরে বাণিজ্যিক অবক্ষয়ের কথা বলেছেন। ৫০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে অর্থনৈতিক চরিত্রে এক বিরাট পরিবর্তন এসেছিল ঠিকই, কিন্তু সামগ্রিক অবক্ষয় ঘটেনি। অন্ত বাণিজ্য বেশ ভালই চলত যা ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় ও চম্পকলক্ষ্মী প্রমাণ করেছেন।
আদি মধ্যযুগে মানুষ কৃষিতে আত্মনিয়োগ করলেও বাণিজ্য কখনোই অবহেলিত হয়নি। প্রাচীন কাল থেকেই ভারতে বাণিজ্য সমাদার পেত। যা শতপথ ব্রাহ্মণ, পেরিপ্লাস প্রভৃতি গ্রন্থগুলি প্রমাণ দেয়। অন্তবাণিজ্যের ক্ষেত্রে ছোট, বড়, মাঝারি হট্টিকার কথা বলা হয়েছে যা আজকের দিনের হাটের সমর্থক (সপ্তাহে দুইবার বা তিনবার বসে)। প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ ক্ষুদ্র বাজার ছিল হট্ট বা হটি্কা। দক্ষিণ ভারতে তেলেগু লেখতে এগুলিকে অড্ড বলা হয়েছে। ডঃ রনবীর চক্রবর্তী সংস্কৃতে বর্ণিত যাত্রা শব্দটির অর্থ মেলা বা মেলা চলাকালীন বাজার অর্থে বুঝিয়েছেন। উত্তর ভারতে একে যাত্রা বলা হত। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে বলা হত মন্থে। এই যাত্রা রোজ বসত না কোন নির্দিষ্ট ঋতুতে, কোন নির্দিষ্ট মাসে বা কোন ধর্মীয় বা সামাজিক পরবের উপলক্ষে বসত এবং দীর্ঘদিন ধরে চলতো। নবম শতকের রাজস্থানের লেখতে বলা হয়েছে কম্বলা ভট্ট বা ঘোড়া কেনার মেলা বসত। এ ধরনের জীবজন্তু কেনা বেচার বাজার বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বসত।
উত্তর ভারতের মন্ডপিকা নামে এক ধরনের বাজারের কথা জানা যায়। সম্ভবত এগুলি হাটের চেয়ে বড় কিন্তু নগরের থেকে ছোট। এগুলির অস্তিত্ব দাক্ষিণাত্যে দেখা যায় না। রাজস্থানে ও গুজরাটে এরকম মন্ডপিকার সংখ্যা ছিল বেশি। মন্ডপিকা গুলি কখনো কখনো বাণিজ্য শুল্ক আদায়ের কাজ করতো। রাজস্থানের মন্ডপিকা গুলির কয়েকটি গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। গোয়ালিয়ার ও জব্বলপুর অঞ্চলের মন্ডপিকা ছিল বড় শহরে যাকে মহামন্ডপিকা বলা হয়েছে।
মহামন্ডপিকার বিকল্প বাজার হিসেবে দক্ষিণ ভারতে পেন্টা, পিন্টা, পেংটা বলে বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল বলে উল্লেখ করেছেন রণবীর চক্রবর্তী ও ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়। যুক্তি হিসেবে তারা দেখিয়েছেন কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ বহুস্থানের নামের শেষে পেট শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। পেট গুলি গ্রাম ও নগরের সহযোগসূত্র (প্রশাসনিক) হিসাবে কাজ করলেও বাণিজ্যিক ক্রিয়াক্রমে লিপ্ত ছিল। এর প্রমাণ মিলে সোমদেব সুরির লেখা গ্রন্থে। অন্ধ্রপ্রদেশের কাকাতীয় বংশের রাজত্বকালে বাহমনী, বরঙ্গলে ১৩ শতকের লেখতে পেংটা শব্দটি পাওয়া যায়। যা পেটা রই ভিন্নরূপ।
দক্ষিণ ভারতে ছিল নগরম। কেনেথ হল চোল লেখমালায় ৩৩ টি নগরমের সন্ধান পেয়েছেন। হল মনে করেন চোল আমলে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে যে প্রশাসনিক কেন্দ্র নাড়ু গঠিত হয়। তার প্রত্যেকটিতে একটি করে নগরম থাকতো। গ্রামের সাথে এর ঘনিষ্ঠ যোগ থাকত এবং শহরাঞ্চলে বাণিজ্যিক লেনদেন চালাত। সব নাড়ুতেই ছিল যে নগরম ছিল একথা বলা যায়না।
উত্তর ভারতে আদি মধ্যযুগের কোন বণিক সংগঠনের নাম পাওয়া যায়নি। তবে দক্ষিণ ভারতে এ সময় দুটি বণিক সংগঠনের অস্তিত্ব জানা যায়। মনিগ্রাম ও নানাদেশী এই সংগঠন বহুদূর দেশ থেকে পণ্য আমদানি করতো। মনি, মুক্তা, বিলাস দ্রব্য, সুগন্ধি দ্রব্য, বস্ত্র প্রভৃতি এবং সেগুলি রাজদরবারে বা অভিজাতদের কাছে বিক্রি করতো। রাজারা এদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং সশস্ত্র প্রহরীর দ্বারা রক্ষার ব্যবস্থাও নিতেন।
বাংলায় স্থানীয় বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে হট্ট বা হাটের অস্তিত্ব তাম্রসূত্রে পাওয়া গেলেও মন্ডপিকা বা পেন্টার কথা জানা যায় না। তবে ডঃ রণবীর চক্রবর্তী দেখিয়েছেন চন্দ্র রাজা শ্রীচন্দ্রের একটি তাম্র শাসনে সম্ভাণ্যারিয়াক শব্দটি পাওয়া গেছে। যার অর্থ যেখানে পণ্য সামগ্রী মজুদ করার ব্যবস্থা আছে। এটি বোধ হয় মন্ডপিকা বা পেন্টার মতোই মাঝারি আয়তনের বাজার।
নদীমাতৃক বাংলার নদী বন্দর গুলি সম্ভবত গ্রাম ও নগরের বড় বাজারের সাথে প্রধান যোগসূত্রের কাজ করতো। বাংলার ময়নামতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল। এছাড়াও আরও যেসব নদী বন্দর ছিল সেগুলি অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বাণিজ্যে অন্তত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো।
আদি মধ্যযুগে বাংলার বাণিজ্য প্রসঙ্গে ডঃ তরফদার তবাকাৎ-ই-নাসিরী কে সম্বল করে বলেছেন এ যুগে বাণিজ্য হ্রাস পেয়েছিল। তাম্র শাসন গুলিতেও বাণিজ্যিকদের তেমন স্থান নেই। বল্লাল সেনের সাথে বণিকদের দ্বন্দ্বের তত্ত্বও পাওয়া যায়। তাছাড়াও মুদ্রা সংকটের কথাতো রয়েছেই। তাই অর্থনীতি কেবল কৃষিভিত্তিক হয়ে পড়েছিল। তরফদারের এই মত নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠার মতো অকাট্য প্রমাণ নেই। তবে ইসলামের আবির্ভাবের প্রাক্কালে এখানে অর্থনৈতিক রূপান্তর হয়েছিল এ কথা ঠিকই।
বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে নদীপথ ও নদী বন্দর গুলি যোগসূত্র হিসেবে কাজ করতো। ভারতের অন্যত্র জলপথের থেকে স্থল পথের গুরুত্ব বেশি ছিল। রাস্তাঘাটও সুরক্ষিত ছিল। এ সময় গাধা বা উটের পিঠে পণ্য সম্ভার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বণিকরা নিয়ে যেত। রাজস্থানের লেখতে পাল রাজারা ষাঁড়ের পিঠে মাল পরিবহন করত। গুজরাটে বলদ, গাধা ও উটের পিঠে মাল পরিবহন হতো। বাণিজ্যের সাথে যুক্ত কিছু রাস্তাঘাটের বিবরণও পাওয়া যায়। চৈনিক বিবরণে কামরূপ থেকে উত্তরবঙ্গ হয়ে রাজমহলের মধ্য দিয়ে মগধে পৌঁছানোর রাস্তার কথা বলা হয়েছে। অলবেরুনি কৌনজ এর সাথে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগের কতগুলি পথের কথা বলেছে। তবে এগুলি বাণিজ্যের কাজে কিভাবে ব্যবহার হতো তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। বণিকদের কাছ থেকে পথ কর ও আদায় করা হতো।
পরিশেষে বলা যায় আদি মধ্যযুগে অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়েছিল তবে বাণিজ্য স্তব্ধ হয়নি। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য আগের মতই চলত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন