বিজয়নগর সাম্রাজ্য সুলতানি আমলে দাক্ষিণাত্যের একটি স্বাধীন সাম্রাজ্য। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে বেশ কয়েকজন বিদেশি পর্যটক বিজয়নগর রাজ্যে এসেছিলেন। এদের লেখায় বিজয়নগরের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চালচিত্রের ছবি ফুটে উঠেছে। এদিক থেকে এসব বিদেশি বিবরণ গুলি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল।
1420 খ্রিস্টাব্দে ইতালীয় পর্যটক নিকোলো কন্টি বিজয়নগর পরিভ্রমণ করেন। তিনি লিখেছেন বিজয়নগর শহরটি 60 মাইল পরিধি ছিল। পর্বতমালার পাদদেশ পর্যন্ত প্রাচীর বেষ্টিত ছিল। শহরে অস্ত্র ধারণ করার মতো 90 হাজার লোক ছিল। এবং রাজা ছিলেন ভারতের অন্য যেকোনো নরপতির থেকে শক্তিশালী। পারসিক দূত আবদুর রাজ্জাক লিখেছেন ধনি, দরিদ্র নির্বিশেষে প্রত্যেক অধিবাসী অলংকার পড়তেন (রত্ন খচিত)। পায়েস নামক পর্তুগিজ পর্যটক বিজয়নগরের বৈভবের কথা বলেছেন। বিজয়নগরের নরপতির অগণিত ধন রত্ন সৈন্য ও হাতি ছিল। তিনি বহিঃবাণিজ্যের উন্নতির কথা ও বলেছেন। প্রচুর উৎপাদন ও দ্রব্যমূল্য কম একথাও বলেছেন। বারবারোসা বিজয়নগরকে এক জনসমৃদ্ধ শহর এবং হীরে, মুক্তা, সিল্ক, কর্পূর, মৃগনাভি, চন্দন কাঠ প্রভৃতি পণ্য দ্রব্যের শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য কেন্দ্র বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং বিদেশী বিবরণ গুলিতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ফুটে উঠেছে।
বিজয়নগরের রাজারা সেচ ব্যবস্থার উন্নতিতে উৎসাহ দিত বলে কৃষির উন্নতি ঘটে, তুঙ্গভদ্রা নদীতে দেবরায় বাঁধ দিয়ে শহরের জল সরবরাহ করা হত ও জলকে সেচের কাজে লাগানো হতো। তুলাজাত দ্রব্য, খাদ্যশস্য ধাতুশিল্প ও গন্ধ দ্রব্যের মূল্য খুব সস্তা ছিল একথা বিদেশি পর্যটকগণ স্বীকার করেছেন।
অভ্যন্তরীণ ও বহিঃবাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিজয়নগর যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করে। বহু বন্দর ছিল এবং ইউরোপের সঙ্গে ও মালব, বার্মা, চীন, আরব, পারস্য, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। কলিকট ছিল গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। বিজয়নগরের কলিকটের মত 300 টি বন্দর ছিল বলে আবদুর রাজ্জাক উল্লেখ করেছেন। এই বন্দর থেকে চাল, কাপড়, লোহা, চিনি, মসলা রপ্তানি হতো। আর আমদানি হত ঘোড়া, হাতি, তামা, কয়লা, পারদ ও চীনের সিল্ক প্রভৃতি পণ্য।
বিজয়নগরের সোনা, তামা ও রুপার মুদ্রা চালু ছিল। জিনিসপত্রের দাম কম ছিল। বিদেশি বিবরণে উচ্চ বর্গের মানুষের জীবনযাত্রার উচ্চমানের ছবি ফুটে উঠেছে। তবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ছবি ফুটে উঠেনি। কারণ পর্যটকরা শহরে থাকতেন। গ্রামে স্বাভাবিকভাবেই তাদের দৃষ্টি যেত না। সম্ভবত সাধারণের জীবনযাত্রা ছিল দুর্বিষহ। অতিরিক্ত করভার ও সরকারি কর্মচারীদের অত্যাচারে তাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছিল। সম্পদ কর, বিক্রয় কর, গোচরণ কর, সামরিক কর, বিবাহ কর তাদের দিতে হতো। যদিও কৃষ্ণদেব রায় বিবাহ কর তুলে দেন।
সমাজে নারীর অবস্থান ছিল যথেষ্ট উঁচুতে। নারীরা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যোগদান করত। শিক্ষা গ্রহণ, অস্ত্রচলনা, মল্লযুদ্ধ প্রশিক্ষণ তারা করতে পারত। নুনিজ এর মতে তারা শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি করতে পারত। সঙ্গীত শিক্ষার জন্য মহিলারা রাজআন্তপুরে নিযুক্ত হতেন। রাজা মহিলা মল্লযোদ্ধা, মহিলা জ্যোতিষী ও মহিলা হিসাবরক্ষক নিয়োগ করতেন। প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগীয় বাতাবরণে মহিলাদের অবস্থানকে সন্তোষজনক বলা যায়। তবে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ও সতীদাহ প্রথা এ যুগে প্রচলিত ছিল
সাম্রাজ্যে ব্রাহ্মণদের অবস্থান ছিল সবার উপরে। রাজনীতি, সমাজ ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। ব্রাহ্মণদের রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে যে কোন কাজে নিয়োগ করা হতো। স্বয়ং রাজা কৃষ্ণদেব রায় ব্রাহ্মণ সেনাপতিদের বিশ্বস্ততার প্রশংসা করেছেন। ব্রাহ্মণরা সাধারণত বুদ্ধিজীবী বলে গণ্য হতেন। তারা দৈহিক পরিশ্রম করতেন না বা করতে পারতেন না। পঠন পাঠন ও সামাজিক দায়িত্ব পালন নিয়েই পড়ে থাকতেন বলে তাদের সামাজিক মর্যাদা ছিল।
বিজয়নগরের রাজা প্রজা সকলে মাছ মাংস খেতেন ।গো মাংস নিষিদ্ধ ছিল, তবে ব্রাহ্মণরা নিরামিষ ভোজন করতেন।
বিজয়নগরের সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রাচুর্যের সাথে সাথে সমাজ জীবনে অন্ধকারও নেমে এসেছিল।গনিকা বৃত্তি বিজয়নগরে ব্যাপকভাবে প্রচালিত ছিল। আবদুর রাজ্জাক লিখেছেন গণিকারা শহরে Brthels থেকে নানাভাবে মানুষকে প্রলোভিত করত। তারা যেকোনো সরকারি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারতো এবং উচ্চ পদাধিকারীরা তাদের সঙ্গদান করলে কলঙ্কের কোন ভয় ছিল না।
অনুষ্ঠান উদ্দেশ্যে ব্যাপক পশু বলি চলতো। নৃপতিগণ নৃশংসভাবে পশু বলি দিয়ে উৎসব পালন করতেন। পায়েস মহানবমী উৎসব পালনের সময় দেখেছিলেন একদিনে আড়াইশো মোষ ও সাড়ে চার হাজার ছাগল বলি দেওয়া হয়েছিল।
সামাজিক জীবনে সহনশীলতা ছিল। সব ধর্মের মানুষের যাওয়া-আসা বা ধর্মাচারণের স্বাধীনতা ছিল। এরকম পরধর্মসহিষ্ণুতা মধ্যযুগীয় ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত।
সমাজে জাতিভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল। বর্ণবিভক্ত সমাজে ব্রাহ্মণরা ছিল সবার উপরে ও সবচেয়ে সুবিধাভোগী। জাতিভেদ প্রথা সামাজিক ও অসামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে রাজশক্তির সমর্থন লাভ করেছিল। বর্ণ বিভক্ত সমাজে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর খাদ্য, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন প্রভৃতি ব্যাপারে স্বতন্ত্র বজায় ছিল। কিন্তু সেচ মন্দিরে পূজা অর্চনা বা অন্যান্য ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক কাজে পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতার কোন অভাব ছিল না। প্রত্যেক শ্রেণী আত্ম সচেতন ছিল, তবে এদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বা বিরোধ কখনোই প্রত্যক্ষ সংঘাতের রূপ নিত না।
বস্তুতঃ বিদেশি পর্যটকদের বিবরণীতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের আর্থসামাজিক বৈভবের কথায় ফুটে উঠেছে। উচ্চবৃত্তের সচ্ছলতা থাকলেও বোধ হয় সাধারণের জীবন ততটা সচ্ছল ছিল না। করভার, কৃষি, পণ্যের কম মূল্য এবং সামাজিক ক্ষেত্রে জাতিভেদ প্রথা, ব্রাহ্মণ প্রাধান্য এরই প্রমাণ দেয়। তবে আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য ইতিহাসের সব যুগেরই বৈশিষ্ট্য এই বৈষম্য আজও রয়েছে। তাই বিজয়নগর কে সমৃদ্ধ বললে কোন ত্রুটি হবে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন