ভারতবর্ষ বরাবর কৃষি প্রধান দেশ। কৃষি এদেশের মানুষের প্রধান জীবিকা। তবে আদি মধ্যযুগের কৃষি ও কৃষকের অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্য পর্যাপ্ত ঐতিহাসিক তথ্যের তথ্যের অভাব রয়েছে। দুটি কৃষি বিষয়ক গ্রন্থ যথা কৃষিসুক্তি ও কৃষি পরাশর এ প্রসঙ্গে বিশেষ সহায়ক। এছাড়া পুরান এবং লিপি সমূহ থেকে পরোক্ষভাবে কৃষি ব্যবস্থা নানা তথ্য পাওয়া যায়। চীনা পর্যটক মা হুয়ান এবং চৌ ডুকুমার রচনা উল্লেখযোগ্য। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সমকালীন কৃষি ব্যবস্থার তিনটি দিক উঠে আসে। এক- কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, দুই- কৃষি প্রযুক্তির উন্নতি, তিন- ভূমি ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন।
হিউয়েন সাঙ সপ্তম শতাব্দীতে ভারত পরিক্রমা করে এক সচ্ছল চিত্র তুলে ধরেছেন। কৃষিসুক্তি ও কৃষিপরাশর গ্রন্থ দুটির রচনা কৃষির ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। সমকালীন শাস্ত্র গুলিতে কৃষিকে উৎকৃষ্ট জীবিকা হিসেবে দেখা হয়েছে। পদ্ম পুরান থেকে জানা যায় প্রাচীন বাংলায় ষাট রকম ধান উৎপন্ন হতো। মধ্যপ্রদেশে বিভিন্ন প্রকার শাক সবজি চাষ হতো। উপকূল ভাগে প্রচুর নারকেল হতো। দক্ষিণ ভারত সুপারি ও পানের জন্য বিখ্যাত ছিল। গুজরাট ও দাক্ষিণাত্যে কার্পাস ও তৈল বিজ ব্যাপকভাবে উৎপন্ন হতো। মালাবার অঞ্চলে মশলা বা গোলমরিচ উৎপাদিত হতো। কাশ্মীরে হতো জাফরান, গুজরাটে কর্পূর, হিং, জায়ফল, জয়তী, মরিচ ও খেজুরের চাষ হতো। বহু ধরনের কৃষিজ ফসল প্রমাণ করে ভারতীয় উপমহাদেশে কৃষি সম্প্রসারণ ঘটেছিল। কৃষি অর্থনীতি দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপিত হয়েছিল।
আদি মধ্যযুগের কৃষি ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল অগ্রাহার ব্যবস্থা। অগ্রাহার হলো রাজকীয় ভূমিদান যা লাভ করত ব্রাহ্মণ, মন্দির, দেবালয় গুলি। সাধারণত রাহা খরচ চালানোর জন্য এগুলি দেওয়া হতো। ব্রাহ্মণদের ভূমিদান ব্রহ্মদেয় এবং মন্দিরের দান দেবদান নামে পরিচিত হতো। আর এস শর্মা ও তার অনুগামীরা অগ্রাহার ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে কৃষি ব্যবস্থার সামগ্রিক অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। পরবর্তীকালে হরবন্ত মুখিয়া ও দীনেশচন্দ্র সরকার, শর্মার বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। শর্মা দেখাতে চেয়েছিলেন অগ্রাহার ব্যবস্থার প্রবর্তনের ফলে, দানগ্রহীতারা অগ্রাহার এলাকার ভূমি রাজস্ব আদায়ের সাথে সাথে শাসন ও বিচারের অধিকার লাভ করেছিল। উৎপাদনের উপকরণগুলির দাম গ্রহীতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। ফলে উৎপাদক শ্রেণী তথা কৃষকদের উপর শোষণের মাত্রা প্রত্যক্ষ হয় ও বৃদ্ধি পায়। দান গ্রহীতারা তাদের জমির থেকে উৎখাতও করত। কৃষক শোষণের এই তথ্য হয়তো বাস্তবিক কিন্তু কৃষক সম্প্রদায় দুরবস্থায় পড়েছিল বলে কৃষি অবনতি হয়েছিল একথা বলা যায় না।
অগ্রাহার ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ দেবালয় বা মঠগুলিকে যে ভূসম্পত্তি দান করা হতো তার অধিকাংশই ছিল পতিত বা অনাবাদী দেখিয়েছেন রণবীর চক্রবর্তী। প্রাচীন বাংলায় অগ্রাহার জমি গুলি ছিল অনাবাদি। এমনকি সপ্তম শতকের শ্রী হর্ষের সামন্ত লোকনাথ দুশত ব্রাহ্মণকে যে ভূমিদান করেছিলেন তার সবকটাই ছিল গভীর অরণ্য। আবার একটি তথ্য থেকে জানা যায় একজন সামন্ত এক উৎপাদন হীন ভূমিতে অনন্ত স্বামীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও মধ্য ভারত, পশ্চিম ভারত ও দাক্ষিণাত্যে সেসব ভূমিদান হতো সেখানে আবাদী জমিও থাকতো। যাইহোক অনাবাদি জমি গুলিতে দানগ্রাহিতার স্থায়ী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা সেগুলিকে আবাদি করার ব্যবস্থা করেন ও কৃষি শ্রমিক নিয়োগ করেন। ফলে অগ্রাহার ব্যবস্থা কৃষির সংকোচন নয় বরং প্রসারণ ঘটিয়েছিল। একথা আর এস শর্মা ও স্বীকার করে নিয়েছে যে অগ্রাহার ব্যবস্থার ফলে বিশাল পরিমাণ পতিত, অনাবাদি জমি কৃষির উপযোগী করতে সক্ষম হয়েছিল।
কৃষি সঙ্গে যুক্ত বেশ কিছু যন্ত্রপাতির কথা জানা যায়। এগুলি কৃষি উৎপাদনে বৈচিত্র এনেছিল। বিগ্রহ রাজের হর্ষ লেখতে বৃহদহলের (বড় নাঙলের) কথা জানা যায়। মঙ্গকোষ গ্রন্থে বলা হয়েছে হাল ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাঠের তৈরি। কৃষি প্রধান জীবনে ঢেঁকির ব্যবহার বেড়েছিল। দামোদর গুপ্তের কুট্টনীমাতম, কলহলের রাজতরঙ্গিনী, সুভাষিত রত্নকোষ ও শ্রীধর দাসের সদুক্তিকর্নামৃত এ ঢেঁকির উল্লেখ পাওয়া যায়। ঢেঁকি ছাড়াও উদুখালের ব্যবহার ছিল। হেমচন্দ্র এর বিস্তৃত ব্যবহার বিবরণ দিয়েছেন।
কৃষির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল সেচ ব্যবস্থা। এ যুগে সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ঘটেছিল। আদি মধ্যযুগের সেচ ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পাওয়া যায় কাশ্মীর থেকে। কলহনের বর্ণনায় কাশ্মীরের সেচ ব্যবস্থার কথা জানা যায়। বিতস্তার বন্যার প্রকোপ থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য রাজা অবন্তী বর্মার শাসনকালে অসামান্য প্রযুক্তি ব্যবস্থার প্রয়োগ ঘটিয়ে বিতস্তার গতিপথ পরিবর্তন করে দেন। এর ফলে দেশবাসী বন্যার প্রকোপ থেকে রক্ষা পায়। এবং কাশ্মীরের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ যুগে সেচের জন্য কুপের জল ব্যবহারিত হতো। গভীর কুপ(বাপি) খনন করে চাষের জমিতে ও জল সরবরাহ করা হতো। গুজরাট ও রাজস্থানে কুপের জলে চাষ হতো।
এ পর্বে সেচের প্রধান যন্ত্রটি হল অরঘট্ট। এই চক্রাকার যন্ত্রের গায়ে অনেক ঘটি বসানো থাকতো। চক্রটি ঘুরলে ঘটি জলভর্তি হয়ে চাষের জমিতে ছড়িয়ে দিত। অনেকে এই যন্ত্রটাকে পারসিয়ান হুইল বলে উল্লেখ করেছেন। ইরফান হাবিব জানিয়েছেন পারসিয়ান চক্র ও অরঘট্ট এক নয়। পারসিয়ান চক্রে একটি গিয়ার থাকতো এবং ঘটি গুলি একটি চেনের সাথে যুক্ত থাকতে বলে গভীর জল তল থেকেও জল উত্তোলন করা যেত। কিন্তু অরঘট্ট যন্ত্রে চাকার গায়ে ঘটি লাগানো থাকতো এবং গিয়ার থাকতো না অপেক্ষাকৃত উঁচু জল তল থেকে জল তোলার জন্য এই যন্ত্র কাজে লাগতো। চোদ্দ শতকে ইবন বতুতা চট্টগ্রাম থেকে কামরূপ যাওয়ার পথে এই যন্ত্রের সাহায্যে জল তুলতে দেখেছিলেন। রাজস্থানে অরঘট্ট বলতে গভীর কূপ কেও বোঝানো হতো।
সেচ ব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য প্রাধান্য পেয়েছিল। রাজারাও অনেক সময় বড় জলাশয় খনন করে কৃষি ক্ষেত্রে সেচের ব্যবস্থা করে দিতেন। রামচরিত থেকে জানা যায় রামপাল বরেন্দ্র অঞ্চলে একটি বিশাল দিঘী খনন করে দিয়েছিলেন। দক্ষিণ ভারতের রাজারাও চোল রাজারাও চোল বারিঠি নামে জলাশয় নির্মাণ করে দেন। দক্ষিণ ভারতে সেচ ব্যবস্থার তদারকি করত গ্রামসভা গুলি। গ্রাম সভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটি জলের সুবন্টন করত এবং জলকর আদায় ও জলাশয় গুলির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করত।
বাংলায় অবশ্য সেচ ব্যবস্থার তেমন উল্লেখ পাওয়া যায়নি অন্তত কৃষি পরাশরে নেই। বরং সেখানে বৃষ্টির জলের ব্যাপক ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তবে কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রকার আচার অনুষ্ঠান যে পালিত হতো তার উল্লেখ রয়েছে। কার্তিক পূজা গবাদি পশুর সুস্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করার জন্য হতো। উর্বরতা প্রসঙ্গে ঋতুমতি মহিলা, বন্ধা, অন্তঃসত্ত্বা বা সদ্য সন্তান জন্মদাত্রী মহিলাকে বীজের সংস্পর্শে আনা হতো না।
কৃষি ব্যবস্থায় আলোচনায় ভূমি ব্যবস্থার কথা বলতেই হয়। ভূমি ব্যবস্থা মূল চালিকাশক্তি ছিল অগ্রাহার ব্যবস্থা। দানগ্রাহিতা যে জমি লাভ করত তা ছিল স্থায়ী। অগ্রাহার ব্যবস্থার ফলে জমিতে রাষ্ট্রীয় ও যৌথ মালিকানা হ্রাস পায়, ব্যক্তি মালিকানার প্রসার ঘটে। গোস্বামীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ভূ-সম্পর্ক ক্রমশ জটিল হয়ে ওঠে। ধর্ম শাস্ত্রে ত্রিস্তর বিশিষ্ট ভূমি ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে রাজা, ভুস্বামী ও কৃষক। ভূ-স্বামী কৃষি উৎপাদনের জন্য কৃষক নিয়োগ করত। ফলে মালিকানা হীন কৃষি শ্রমিকের উদ্ভব হয়েছিল। দান গ্রহীতা ভূস্বামী তার সীমানার বাইরে পার্শ্ববর্তী চারণভূমিতে চাষ বসিয়ে আয় বাড়াতে পারতেন তবে তা পূর্ব ভারতেই দেখা যায়।
গোস্বামীরা শুধু জমির অধিকার লাভ করেনি রাজনৈতিক সামরিক ক্ষমতার অধিকারও লাভ করেছিল। শর্মা ও তার অনুগামীরা দেখিয়েছেন ভুস্বামীরা জনগণের কাছ থেকে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আদায় করতো, যেমন উচিত অনুউচিত কর আদায় করতো। কলহানের রাজতরঙ্গিনী থেকে জানা যায় রাজারা কৃষকদের হাতে ন্যূনতম জীবন ধারণের ব্যবস্থা রেখে বাকি সবটাই আদায় করতো। এ যুগের বিভিন্ন রচনায় কৃষকের উদ্দেশ্যে হালকা ও বদ্ধহল, আশ্রিত হালিক প্রভৃতি প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। পদ্মপুরাণে কৃষকদের দুর অবস্থার কথা পাওয়া যায়। এর প্রেক্ষিতে রামশরণ শর্মা সামন্ততন্ত্রের তথ্য খাড়া করেছেন। কিন্তু উপিন্দর সিং মনে করেন ভূ-স্বামী সামন্ত ছিলেন না। কারণ রাজার সঙ্গে কোন সামরিক চুক্তি তাদের হতো না। যাইহোক ভূ-স্বামী শ্রেণীর আবির্ভাবের ফলে কৃষকদের উপর শোষণের মাত্রা আরও প্রত্যক্ষ ও তীব্র হয়েছিল তা বলা যায়।
পরিশেষে বলা যায় যে নতুন কৃষি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তার দুটি দিক এক অগ্রাহার ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি, অন্যদিকে ওই অগ্রাহার ব্যবস্থার ফলেই কৃষকদের পরিস্থিতির অবনমন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন