তুর্কিরা বাগদাদ- পারস্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য গজনি হয়ে ভারতের ভূমিতে বহন করে এনেছিল। ওই সময় বাগদাদ পারস্য সংস্কৃতি ছিল উৎকর্ষের চরম শিখরে। এই তুর্কিরাই ভারতের দিল্লির সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। তুর্কিরা যখন ভারতে আসে তখন শাসন শিল্প ও স্থাপত্য সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা নিয়েই আসে। ভারতীয় উচ্চ মানের সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্যের সঙ্গে তুর্কি জাতির শিল্প স্থাপত্যের উচ্চ ধারণার সংমিশ্রণে ভারতে এক নতুন স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ ঘটে যাকে আমরা ইন্দো ইসলামিক বা ইন্দো পারসিক অথবা ইন্দো সেরাসেনিক স্থাপত্য রীতি বলি। এছাড়াও মঙ্গলদের আক্রমণে সেলজুক তুর্কি সাম্রাজ্য ভেঙে গেলে বহু তুর্কি ভারতে আশ্রয় নেন। শুধু পন্ডিত ও সংস্কৃতিবান লোক ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ কারিগররাও ভারতে এসেছিল যার ফলে সেলজুক শিল্প-সংস্কৃতি ভারতের প্রবেশ করে। যার চূড়ান্ত প্রতিফলন দেখা যায় মুঘল যুগের স্থাপত্য রীতিতে।
ত্রয়োদশ শতাব্দি থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে এই শিল্প রীতি কে পাঁচটা ভাগে ভাগ করা যায় যুগ ও শৈলী অনুযায়ী। প্রথমত- 1246 সাল পর্যন্ত দ্বিতীয়ত- 1290 থেকে 1320 তৃতীয়ত- 1320 সাল থেকে 1423 চতুর্থতঃ-1414 থেকে 1444 পঞ্চমত- 1451 থেকে 1557 সাল পর্যন্ত।
কুতুবউদ্দিন আইবক কিল্লা রাই পৃথোরা দখল করে দিল্লিতে রাজধানী স্থাপন করেন। ওখানে উনি 212 ফিট লম্বা,150 ফিট চওড়া কোওয়াউল মসজিদ নির্মাণ করেন। এটি প্রথমে একটি জৈন মন্দির ও পরে বিষ্ণু মন্দির ছিল। এই মসজিদের চারিদিকে দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে পাথর নিয়ে হিন্দু কারিগরদের দিয়ে এই মসজিদ তৈরি হয়।
কুতুবউদ্দিন আইবক শেষ দিকে কুতুব মিনার তৈরি শুরু করেন। প্রথম দিকে এর উচ্চতা ছিল ২৩৮ ফিট। যার দেওয়ালে কোরআনের অংশ খোদাই করা হয়েছে। এটাকে আবার পূর্বদিকে ইসলামের সীমানা হিসেবেও ধরা হয়। কুতুব মিনারের চারটি স্তর আছে এবং এটি ক্রমশ উঁচুতে সরু হয়ে এসেছে। ইলতুৎমিস কুতুবমিনারের কাজ সম্পন্ন করেন। 1368 সালে এই মিনারের ভাঙ্গন ধরলে ফিরোজ শাহ তুঘলক মার্বেল পাথর দিয়ে এটি সারান। আজমিরে আড়াই দিনকা ঝোপরা কুতুবুদ্দিন তৈরি করেন এটি সম্ভবত একটি বৌদ্ধমঠ ছিল। আড়াই দিনের একটা মেলা বসত যার থেকে এই নামকরণ হয়েছে।
তুর্কিরা নিজেদের বসবাসের জন্য প্রাসাদ নির্মাণ করতে শুরু করলেন তখন এ কাজে ভারতীয় স্থাপতি ও শিল্পী দের নিযুক্ত করতে লাগলেন এবং মসজিদ নির্মাণে বৌদ্ধ ও জৈন মন্দিরের উপাদান ব্যবহার করা হতো। তুর্কিরা তাদের মসজিদে প্রচুর পরিমাণে খিলান ও গম্বুজ ব্যবহার করতেন। খিলান ও গম্বুজের ব্যবহার তুর্কিদের নিজস্ব রীতি নয়। এটি আরব জাতি রোম থেকে গ্রহণ করেছিল তারপর সেটি আরবদের কাছ থেকে গ্রহণ করে তুরকিরা এদেশে নিজস্ব ধারায় বিকাশ করে।
ইলতুৎমিস বদাউনের জামি মসজিদ নির্মাণ ছাড়াও তাঁর ছেলের ও নিজের সমাধি সৌধ তৈরি করেন। পুরানো দিল্লিতে1235 সাল নাগাদ ইলতুৎমিস তাঁর সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন। এটি ছিল একটি চতুষ্কোণ সৌধ। এটিতে তিনদিক দিয়ে ঢুকবার দরজা আছে। এবং প্রতিটি দরজা খিলান দেওয়া। ভিতরের হলঘরটি 30 ফুট খোদাই করা। লাল পাথরের দেয়ালে সাদা মার্বেল পাথরের উপর বিভিন্ন ইসলামিক শৈলীতে কোরআনের অংশবিশেষ খোদাই করা। দেওয়ালের গায়ে নানা রকমের জ্যামিতিক চিত্র বিচিত্র খোদাই করা আছে।
আলাউদ্দিন খলজী কুতুব মিনারের পাশে কুতুব মিনারের দ্বিগুণ এক মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তার এই কাজ 1316 সালে মৃত্যুর পর আর এগোইনি। তিনি অনেক সমাধি সৌধ তৈরি করেন। 1305 খ্রিস্টাব্দে তিনি একটি পরিপূর্ণ দরজা বা আলাই দরজা নির্মাণ করেন। এটি ছিল মসজিদের উঠোনে যাওয়ার দক্ষিণ দিকের দরজা। এর স্থাপত্য শৈলী থেকে বোঝা যায় যে দক্ষ স্থপতি এর সাথে যুক্ত ছিল। যারা নতুন ধারণা নিয়ে এসেছিল। খিলান গুলির চেহারা, দেওয়াল তৈরি করার রীতি, গম্বুজকে ধরে রাখার ব্যবস্থা এই নতুনত্বের প্রভাব দেখা যায়।
আলাউদ্দিন নির্মিত সৌধ নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগা। এই দরগার নতুনত্ব ছিল ঘোড়ার খুরের মতো খিলানের স্থাপত্য। এর সামনে খিলানযুক্ত তিনটি দরজা আছে। যার দুপাশে খোদাই করা কারুকার্য আছে। তিনটি দরজা তিনটি ঘরকে সংযুক্ত করে রেখেছে প্রত্যেক ঘরেই গম্বুজ লাগানো।
তুঘলক যুগে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তুঘলকাবাদ শহরের প্রতিষ্ঠা করেন যদিও এখন শুধুই ধ্বংস বিশেষ আছে। ইবন বতুতা বলেছেন যে এখানে তুঘলক রাজা সোনার ইট দিয়ে বিশাল প্রাসাদ তৈরি করেছিলেন যা সূর্য ওঠার সঙ্গে রোদ পড়ে ঝলমল করতো। তুঘলকাবাদের দুটো ভাগ ছিল একটি দুর্গ ও অন্যটি শহর। চতুর্দিক এটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল। এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই গিয়াস উদ্দিন তুঘলকের সমাধি সৌধ অটুট রয়েছে। এটি ছিল একটি হ্রদের মাঝখানে। এর চেহারা একটা ছোট দুর্গের মত। এটির দরজা এমনভাবে তৈরি যে জোর করে ঢুকতে গেলে মৃত্যুর সম্মুখীন হতে হবে। ভিতরের উঠানে কতকগুলি চোরা কুঠুরি আছে যার ভিতর কিছু নেই। ইবন বতুতা অনুসারে এখানে একসময় ধনরত্নে পরিপূর্ণ ছিল। এই সমাধি দুর্গের বাইরের চেহারাটা ছিল অসমান পঞ্চকোণ। এছাড়াও এই প্রথম খিলানের নিচে চৌকাঠ দেখা যায়।
দিল্লি সুলতানি যুগের কারুকার্যময় জাঁকজমকপূর্ণ শিল্প রীতি ফিরোজ শাহ তুঘলকের সময় যেন স্লান হয়ে যায়। তুঘলক যুগের শিল্প রীতি ছিল খুবই সরল সাদামাটা। তুঘলকরা তাদের অট্টালিকায় দামি লাল বেলে পাথর ব্যবহার করতেন না তারা ব্যবহার করতেন সস্তা সহজলভ্য ধূসর রঙের পাথর। এসব পাথরের উপর অলঙ্করণ বা কারুকার্য করা সহজ ছিল না। তাই তো তুঘলকদের অট্টালিকায় কারুকার্য কম দেখা যায়। ফিরোজশাহ তুঘলকের নির্মিত অধিকাংশ অট্টালিকায় অলঙ্হিকরণ হিসাবে হিন্দু প্রতীক পদ্মের ব্যবহার দেখা যায়। স্থাপত্য রীতিতে এই পরিবর্তনের জন্য অনেকে তুঘলকদের আর্থিক সংকট ও তাদের ধর্মবিশ্বাসকে দায়ী করেছেন। মোহাম্মদ বিন তুঘলকের সময় দৌলতাবাদে বহু কারিগরকে নিয়ে যাওয়ার ফলে সম্ভবত দিল্লিতে দক্ষ কারিগর ও স্থপতি ছিল না। মোহাম্মদ বিন তুঘলকের সময়ে বিভিন্ন বিদ্রোহের ফলে সরকারি কোষাগারের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছিল। এর ফলে প্রথমদিকের সৌদ গুলিতে চুন সুরকি লেপা হয়েছিল ভালো করে না কাটা পাথরের উপর। দরজা, চৌকাঠ, পাঁচিল এমনভাবে তৈরি যেন বড় অসমান। এক ধরনের অনুজ্জ্বল রং অনেক সময় লাগানো হয়েছিল যা মোটেও দৃষ্টি নন্দন নয়।
ফিরোজ শাহের স্থাপত্যের মধ্যে অন্তত চারটি দুর্গ শহর এবং একটা শহর আছে যাকে দিল্লির পঞ্চম শহর বলা হয়। এই শহরকেই ফিরোজাবাদ বলে। এটি যমুনার পাড়ে 1354 খ্রিস্টাব্দে এটি তৈরি করেছিলেন। এর পরিকল্পনা ও তুঘলকাবাদের নগর দুর্গের মতই ছিল কিন্তু এখানে এটি আরো উন্নত ছিল। পাঁচিল দিয়ে সব দিক ঘেরা ছিল। এর প্রধান প্রবেশপথ ছিল পশ্চিম দিকে যেখানে শক্ত দরজা রয়েছে এই দরজা কে সুরক্ষিত করা হয়েছে বাইরে থেকে বেরোনোর উঁচু তোরণদ্বার দিয়ে যেখানে রক্ষীরা থাকতো। পিছনের উঠোনে ছিল রক্ষীদের থাকার জায়গা। এর মাঝখানে ছিল জামি মসজিদ যার ভিতরে 10000 লোক সমবেত হতে পারতো। রাজ পরিবারের লোকদের জন্য এর আলাদা ভিতর জায়গা ছিল।
বহিরাগত তুর্কি রীতির সঙ্গে প্রচলিত ভারতীয় স্থাপত্য রীতি মিশে এক নতুন ভারতীয় রীতির উদ্ভব হয়েছিল। দিল্লিতে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি থাকায় এর স্থাপত্য রীতিতে ইসলামীয় স্থাপত্য রীতি অব্যাহত ছিল। কিন্তু প্রায় প্রত্যেক প্রদেশে নিজস্ব শিল্পীরীতি গড়ে ওঠে, জৌনপুর, মালোব, গুজরাট ও বঙ্গদেশে যে সমস্ত মসজিদ ও অট্টালিকা নির্মিত হয়েছিল তাদের মধ্যে স্থানীয় প্রভাব গভীরভাবে পড়েছিল।
দাক্ষিণাত্যে শিল্প স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিজাপুরে পাওয়া যায়। বিজাপুরের মোহাম্মদ আদিল শাহের কবরের উপর নির্মিত গোলগম্বুজ গঠন কৌশলে অনবদ্য। বাহমনী রাজ্যের শিল্প স্থাপত্যে ভারতীয়, মিশরীয়, তুর্কি ও পারসিক প্রভাব দেখা যায়। বাহমনী রাজ্যের স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন গুলবর্গার জামি মসজিদ, দৌলতাবাদে অবস্থিত চান্দমিনার এবং মাহমুদ গাওয়ান কর্তৃক নির্মিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
সুলতানি আমলে বঙ্গদেশের স্থাপত্য রীতিতে এক নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়েছিল। বঙ্গদেশে স্থাপত্য শিল্পে দো চালা বা চৌ চালার অনুকরণে বঙ্গদেশের মসজিদসমূহ নির্মিত হয়েছিল। এই সকল মসজিদে পদ্ম ফুলের নকশা কাটাও ছিল। সিকান্দার শাহ নির্মিত 400 গম্বুজ বিশিষ্ট পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ, হোসেন শাহের রাজত্বকালে নির্মিত ছোট সোনা মসজিদ, নসরৎ শাহের সময়ে সমাপ্ত বড় সোনা মসজিদ, দাখিল দরওয়াজা ও কদম রসুল বঙ্গদেশের নিজস্ব রীতির সুন্দর দৃষ্টান্ত।
ভারতীয় স্থাপত্য রীতি- হিন্দু ও মুসলমানি স্থাপত্য রীতির এই দুই ধারার দানেই পরিপুষ্ট হয়েছে। এবং তার সাথে ধর্ম, ব্যক্তিগত রুচি ও স্থানীয় ভাবধারা প্রভৃতির প্রভাবের ফলে এদেশে এ যুগে নতুন এক স্থাপত্য রীতির উদ্ভব ঘটে। ভারতীয় কারিগররা পদ্ম ফুলের ন্যায় দেশীয় প্রচলিত প্রতীকের সঙ্গে ইসলামীয় রীতির জ্যামিতিক নকশা, সূক্ষ্ম আকারে লেখা ও নানা লতাপাতার নকশাও ব্যবহার করেছিলেন। স্থাপত্য সংস্কৃতি ও কলার ক্ষেত্রে এই যে সমন্বয় তার যুগ যুগ ধরে স্থায়ী হয়ে আছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন