জাপানে সমরবাদের উত্থান: কুরাই তানিমা
১৯৩১ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে জাপানের ইতিহাসে কুরাই তানিমা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। এর অর্থ হলো অন্ধকারাচ্ছন্ন উপত্যকা। আলোচ্য করবে দেখা যাবে যে, ১৯২০-র দশকে জাপানে যে গণতন্ত্র ও উদারনীতিবাদের বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল সেগুলিকে সমূলে উৎপাদিত করে জঙ্গি জাতীয়তাবাদ এবং সমরবাদের প্রসার ঘটেছিল। এবং এর ফলে জাপান ক্রমশ ফ্যাসিবাদের পথে এগিয়েছিল। অমানবিক হিংসা এবং রাজনৈতিক হত্যালীলা জাপানের রাজনীতিতে একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়। দেশের অভ্যন্তরে একের পর এক রাজনৈতিক হত্যা সংঘটিত করার ষড়যন্ত্র এবং বিদেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপ্রতিহত আগ্রাসন ছিল এই পর্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য, যা জাপানকে ক্রমশ এক অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
জাপানে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানের পিছনে একাধিক কারণ ছিল। প্রথমত, বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দা জাপানের অর্থনীতিকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। জাপানি পণ্যের রপ্তানি হ্রাস পাওয়ার ফলে কৃষক শ্রেণীর অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিল। এই সময় জঙ্গি জাতীয়তাবাদী ও সামরিক কর্তৃত্বের সমর্থকরা প্রচার করেছিল যে বৈদেশিক রাষ্ট্রসমূহের শুল্কনীতি এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গতিবিধির উপর নির্ভর না করে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী নীতি অবলম্বন করে বিদেশি বাজার দখল করা দরকার। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণিগুলির কাছে এই যুক্তি যথেষ্ট মনপুত হয়েছিল। কর্মী ছাঁটাই ও মজুরী হ্রাসের ফলে ১৯৩০ এর দশকের গোড়ার দিকে শ্রমিক শ্রেণীও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তবে তারা উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান করেছিল।
দ্বিতীয়তঃ জাপানের অসামরিক শাসনকর্তাদের মধ্যে এই সময়ে ব্যাপক দুর্নীতি দেখা দিয়েছিল জনসমক্ষে তাদের মর্যাদাহানি হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের মনে হয়েছিল প্রশাসনে সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে এই ব্যাপক দুর্নীতির অবসান ঘটবে অসামরিক রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির পাশাপাশি সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা পরায়ণতা দেশ ও সম্রাটের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য এবং দেশপ্রেম সাধারণ মানুষের সামনে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। সাধারণ মানুষের একটা বিরাট অংশ দেশের সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাতে আরম্ভ করেছিল।
তৃতীয়ত, ইউরোপে ইতালীয় জার্মানিতে ইতিমধ্যেই ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এই ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির আপাত সাফল্য জাপানি জনগণের একাংশ কে অনুপ্রাণিত করেছিল। তারা মনে করেছিলেন জাপানের তদানীন্তন আর্থিক সংকট এবং দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ ও জৈবাৎসু গোষ্ঠীর অশুভ মেলবন্ধনের একমাত্র উত্তর জঙ্গি জাতীয়তাবাদ ও সামরিক গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব।
১৯৩১ সালের শেষ দিকে ওয়াকাতসুকি মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী হন সেইযুকাই দলের ইনুকাই। এরপর জাপানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক খুন হয়। লিগ অফ ব্লাড নামে উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর হাতে নিহত হন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ইনোয়ুয়ে এবং মিৎসুই কোম্পানির ডিরেক্টর ব্যারন ডান। এবার উগ্রপন্থী সামরিক করমচারীর হাতে খুন হলেন প্রধানমন্ত্রী ইনুকাই। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটাই যে এই তিনটি খুনের বিচারের সময় জনগনের সহানুভুতি হত্যাকারীদের দিকেই ছিল এবং এরা কেউই মৃত্যুদন্ড পাননি এই যুক্তিতে যে এই খুন ছিল নিঃস্বার্থ।
ইনুকাই-এর পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী হন মধ্যপন্থী সাইটো। কিন্তু তাঁর যুদ্ধমন্ত্রী জেনারেল আরাকি ছিলেন মন্ত্রীসভার সবথেকে ক্ষমতাবান সদস্য। তাঁর সহযোগী জেনারেল মাজাকির নেতৃত্বাধীন একটি সামরিক গোষ্ঠী ছিল কোডা-হা এবং এর বিরোধী গোষ্ঠী ছিল টোসেই-হা। এই দুই বিবাদমান গোষ্ঠীর অবশ্য একটাই লক্ষ্য ছিল সংসদীয় ব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে সম্পূর্ণ সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা। ইতিমধ্যে জাপান বেআইনি ভাবে মাঞ্চুরিয়া দখল করে এবং এই সাফল্য উগ্র জাতীয়তাবাদকে প্রবল আত্মবিশ্বাস প্রদান করে। মাঞ্চুরিয়ায় জাপানি সেনা ঘোষনা করেছিল জৈবাৎসুকে, বিশেষ করে মিৎসুই ও মিৎসুবিশিকে মাঞ্চু-কুয়োর সম্পদে ভাগ বসাতে দেবে না। এর ফলে মাঞ্চু-কুয়ো অঞ্চলে একদল নতুন জৈবাৎসু গড়ে ওঠে, যারা শিঙ্কো-জৈবাৎসু নামে পরিচিত। এদের মধ্যে অন্যতম ছিল নিশান।
১৯৩২ এর পর থেকে জাপান সকলপ্রকার উদারবাদী চিন্তাভাবনাকে দমন করতে শুরু করে। মার্কসীয় চিন্তাধারা দমন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বামপন্থী লেখক কোবাযাশি তাকাজি পুলিশ হেফাজতে নিহত হন। শিক্ষকদের পঠন পাঠনের থেকে বেশি করে ধর্মীয় উপাখ্যান (শিন্টো ধর্ম), জাতিগত উৎকর্ষতার কথা এবং সামরিক বাহিনীর মাহাত্ম প্রচারের উপর গুরুত্ব দিতে বলা হয়। অসংখ্য শিক্ষক-অধ্যাপক ছিলেন যারা এর বিরোধিতা করেছিলেন এবং তাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল এবং অনেককে জেলবন্দী করা হয়েছিল। সারা দেশে অন্ধ ও উন্মত্ত জাতীয়তাবাদীতে ভরে যায় এবং তাদের হাতে নাগরিকদের লাঞ্ছিত হওয়া ও প্রান হারানো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার হয়ে ওঠে।
১৯৩৪ এর সালে সাইটো মন্ত্রীসভার সদস্যদের খুন করার একটি ষড়যন্ত্র হয়, কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যর্থ হন, পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এই ঘটনার পর সাইটো মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হন ওকাদা। ওকাদা মন্ত্রীসভা ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের শিকার হয় এবং বেশ কয়েকজন মন্ত্রীকে তারা হত্যা করে। এই অভ্যুত্থানের নেতারা, যারা সবাই ছিল বয়সে তরুন, একটি প্রচারপত্র বিলি করেছিল, যাতে লেখা ছিল প্রবীন রাষ্ট্রনেতা, জৈবাৎসু এবং রাজনৈতিক দলগুলিই জাপানের সংকটের জন্য দায়ি এবং এদের খতম করা দরকার।
উপরিউক্ত অভ্যুত্থানের পর ওকাদা মন্ত্রীসভার পতন ঘটে এবং গড়ে ওঠে হিরোতা মন্ত্রিসভা। এই মন্ত্রীসভার সামরিক বাহিনীর প্রভাব ছিল ব্যপক। মাত্র চারজন ছাড়া সব সদস্যই ছিল সামরিক ব্যক্তি। হিরোতা মন্ত্রীসভা সামরিক খাতে বরাদ্দ ব্যপক হারে বৃদ্ধি করে। এই সরকারই ফ্যাসিস্ট ইতালি এবং নাৎসি জার্মানির সাথে Anti-Comintern Pact স্বাক্ষর করেছিল। এই সরকারে সামরিক বাহিনীর প্রভাব প্রতিবাদে রাজনৈতিক দলগুলি প্রতিবাদ জানাতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধমন্ত্রী তেরাউচি ডায়েটের নিম্নকক্ষ House of Representative ভেঙে দেওয়ার আবেদন জানান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাতে অসম্মত হলে তিনি পদত্যাগ করেন এবং এরপর হিরোতা মন্ত্রীসভা ভেঙে পড়ে।
এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে উগাকির নাম প্রস্তাবিত হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হন জেনারেল হায়াশি। হায়াশি রক্ষনশিল সামরিক নেতা এবং ফ্যসিবাদের পক্ষে। তিনি 'এক দেশ এক দল'- এই নীতির উপর জাপানকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একের পর এক হত্যা, অভ্যুত্থান এবং সরকার বদলে জাপানের জনগন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এবং চরম দক্ষিনপন্থা থেকে সরে আসছিল। তাই ১৯৩৭ এর নির্বাচনে হায়াশি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হন ফুজিয়ারা গোষ্ঠীভূক্ত নেতা প্রিন্স কোনোয়ে। আশা করা হয়েছিল কোনোয়ে সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে এবং একটি মধ্যপন্থী শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু এই আশা পুরনে ব্যর্থ হয় কোনোয়ে মন্ত্রীসভা। দায়িত্ব গ্রহনের এক মাসের মধ্যে জাপানের সামরিক বাহিনী অন্যায়ভাবে চিন আক্রমণ করে (জুলাই, ১৯৩৭)। ফলে আবার সামরিক বাহিনীর প্রাধান্য আবার বৃদ্ধি পায়, জঙ্গী জাতিয়তাবাদ ও উগ্র দক্ষিনপন্থীরা নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করে। সরকার যুদ্ধবাজদের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়। জাপানের নগ্ন সাম্রাজ্যবাদের পর্ব শুরু হয়, যা হিরোশিমা ও নাগাসাকির পর স্তব্ধ হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন