সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তুমি কি মনে করো বিজয়নগর এবং বাহমনীর মধ্যে সংঘাতের মূল কারণ ছিল ধর্মীয়?

 

সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন ও মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা এই দুটি প্রক্রিয়া যখন একই সাথে এগোচ্ছে তখন দক্ষিণ ভারতে দুটি পরস্পর বিদ্যমান শক্তি বিজয়নগর ও বাহমনী উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন। প্রায় দুই শতধিক বছর জুড়ে এই দুটি সাম্রাজ্যের বিবাদকে অনেক ঐতিহাসিক ধর্মনৈতিক চরিত্র দান করার চেষ্টা করেছেন। কারণ বাহমনী ছিল মুসলিম শাসিত আর বিজয়নগর ছিল হিন্দু শাসিত কিন্তু আধুনিক ইতিহাস চর্চায় সেই দিকটি খারিজ হয়ে গেছে।


প্রায় একই সময়ে তুঘলক বংশের পতনের পর দক্ষিণ ভারতে বাহমনী ও বিজয়নগর সাম্রাজ্য স্থাপিত হয় আলাউদ্দিন বহমান শাহ প্রথমটির প্রতিষ্ঠাতা যার রাজধানী ছিল গুলবর্গা ও পরে বিদর। দ্বিতীয়টির প্রতিষ্ঠাতা ছিল হরিহর ও বুক্কা যাদের রাজধানী ছিল তুঙ্গাভদ্রা তিরস্ত বিজয়নগর। বিজয়নগর বাহামনি সংঘাত নির্বিচ্ছিন্ন ছিল না মাঝে মাঝে শান্তি স্থাপিত হতো। তবে বিরোধের মীমাংসা হতো না। 


কিংবদন্তি অনুসারে হরিহর ও বুক্কা কাম্পিলি রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন। মোহাম্মদ বিন তুঘলকের কম্পিলি অভিযানে তারা ধৃত হন এবং তাদের ধর্মান্তরিত করে দাক্ষিণাত্যে বিদ্রোহ দমনের ভার দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু পরে নতুন ধর্ম ও নতুন প্রভু ত্যাগ করে গুরু বিদ্যারন্যের এর অনুরোধে পুনরায় হিন্দু শৈব ধর্ম গ্রহণ করেন এবং হিন্দু ধর্ম ও সাংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য মহান আদর্শ নিয়ে হোয়সাল ও মাদুরার দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে একটি রাজ্য স্থাপন করে। এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিক এ এল শ্রীবাস্তব‌ বিজয়নগর ও বাহমনীর সংঘাতকে ধর্মীয় রূপ দিয়েছেন। দক্ষিণ ভারতের মুসলিম আগ্রাসন রোধ করে বিজয়নগর সাম্রাজ্য হিন্দুধর্ম ও সাংস্কৃতিকে রক্ষার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়েছিলেন। 


আধুনিক ঐতিহাসিক দেখিয়েছেন বিজয়নগর ও বাহমনীর দ্বন্দ্বের আসল কারণ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। অধ্যাপক সতীচন্দ্র এই দ্বন্দ্বের অর্থনৈতিক দিকটা তুলে ধরেছেন। তার মতে দ্বন্দ্ব ছিল তিনটি অঞ্চল কে নিয়ে। তুঙ্গভদ্রা দোয়াব বা কৃষ্ণাগোদাবরী বদ্বীপ ও মারাত্তায়া দেশ। প্রথমটি উর্বর হওয়ায় অর্থনৈতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল এবং এটা নিয়ে ইতিপূর্বে চোল, চালুক্য ও যাদব হোয়সাল দের মধ্যে বিরোধী বেঁধেছিল। কৃষ্ণা গোদাবরী এলাকা ছিল উর্বর এবং এখানে অনেকগুলি বন্দরও ছিল যা বহিবাণিজ্যের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মারাত্তায়া ও কঙ্কন ছিল পশ্চিমঘাট ও সমুদ্রের মধ্যবর্তী এক ভূখণ্ড এটি যেমন উর্বর এবং ইরান ও ইরাক থেকে ঘোড়া আমদানি করার প্রধান কেন্দ্র। গোয়া এখানেই অবস্থিত ছিল।


এমন কতগুলি বিষয় চোখে পড়ে যা দেখে মনে হয় না যে বিজয়নগর বাহমনী দ্বন্দ্বের মূল বিষয় ছিল ধর্মীয়। প্রথমত বিজয়নগরের রাজারা শৈব হলেও পরধর্মসহিষ্ণু ছিলেন। ফিরিস্তার বিবরণ থেকে জানা যায় রাজা দেবরায়ের বাহিনীকে ১০০০ মুসলমান ছিল। আব্দুর রাজ্জাক ও বারবসা বলেছেন বিজয় নগরের সব ধর্মের মানুষ নির্ভয়ে বাস করতেন। 


এদিকে বাহমনী শাসকেরা ও ধর্মগোড়া ছিলেন না প্রথমত আলাউদ্দিন বহমান শাহ জিজিয়া কর তুলে দেন। সরকারি চাকরিতে হিন্দুদের নিয়োগ করতেন। দৌলতাবাদের একটি মান মন্দির তৈরি করেন। বরাঙ্গলে হিন্দু রাজাদের সঙ্গে বাহমনী রাজ্যের বন্ধুত্ব ছিল। বিজয় নগরের সাথেও মাঝে মাঝে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতো। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে অর্থাৎ কোন পক্ষই নিজ রাজ্যে ভিন্নধর্মীদের উপর অত্যাচার করত না। 


তবে দ্বন্দের মধ্যে ধর্মীয় আবেগ যে একেবারেই ছিল না তা বলা যাবে না সমসাময়িক ঐতিহাসিক ফিরিস্তা ও একে ধর্মীয় দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখেছেন। বিজয়নগরের রাজা মল্লিকার্জুন রায় মুসলমানদের একবার নির্বিচারে হত্যার নির্দেশ দেন কারণ মুসলমান বণিকরা বাহমনী সুলতানের কাছে আমদানি করা সব মোয়া বিক্রি করেছিলেন। এর প্রত্যুত্তরে বাহমনী বিজয় নগর আক্রমণ করেছিল। কখনো কখনো বাহমনী বিজয়নগরের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতো। বিজয়নগরের বিরুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাহমনীর পর প্রতিষ্ঠিত পাঁচটি মুসলিম রাজ্যের মিলিত আক্রমণকে তালিকোট্টা যুদ্ধ ১৫৬৫ কে অনেক ঐতিহাসিক বিজয়নগরের ধর্মগোড়া মনোভাবের ফল হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। 


আসলে মধ্যযুগে সাম্প্রদায়িকতা বলে কিছু ছিল না লড়াই ছিল জমি দখলের লড়াই। তবে এই লড়াই সৈন্যদের উৎসাহিত করতে প্রায়ই ধর্মীয় তত্ত্বকে ব্যবহার করা হতো। সম্ভবত ধর্মীয় বিদ্বেষ সাধারণের মধ্যে ছিল না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ | Category of Archives

মহাফেজখানার শ্রেণীবিভাগ মহাফেজখানা বা লেখ্যাগারগুলি সাধারণ জনতার জন্য নয় মূলত গবেষক, ঐতিহাসিক, আইনবিদ, চিত্র পরিচালক প্রভৃতি পেশার লোকজন তাদের গবেষণার কাজে লেখ্যাগারে নথি পত্র দেখতে পারেন।  লেখ্যাগার পরিচালনা ও সংরক্ষিত নথির ভিত্তিতে লেখ্যাগগুলিকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।   1. সরকারি লেখ্যাগার:- কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার বা স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে যে লেখ্যাগারগুলি গড়ে ওঠে। সেগুলিকে সরকারি লেখ্যাগার বলা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এরকম সরকার পরিচালিত এক বা একাধিক লেখ্যাগার থাকে। যেমন, আমেরিকার Natonal Archive And records Administration (NARA)। ভারতবর্ষে র কেন্দ্রীয় লেখ্যাগার National Archive of India নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রশাসনিক ও আইনগত নথি, মানচিত্র, নক্সা,  পাণ্ডুলিপি প্রভৃতি সংরক্ষিত থাকে। 2. বানিজ্যিক লেখ্যাগার:-  এটি একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানের লেখ্যাগার বিভিন্ন বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান   মূলত তাদের সংস্থার ঐতিহাসিক এবং বানিজ্যিক নথি সংরক্ষিত রাখে। যেমন, ভারতের প্রথম বানিজ্যিক লেখ্যাগার হলো পুনার Tata Centrel Archive। 3. অলাভজনক লেখ্যাগ...

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য | Arab Conquest of Sindh: Immediate Causes and Significance

আরবদের সিন্ধু অভিযানঃ প্রত্যক্ষ কারণ ও তাৎপর্য সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে আরবদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম আরবদের নতুন করে জীবনীশক্তির সঞ্চার করে । ইসলাম ক্রমশ: একটি ধর্ম থেকে রাজনৈতিক শক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় তারা আরবীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। ভারতবর্ষের সঙ্গে আরবদের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। বাণিজ্যিক সূত্রে তারা নিয়মিত ভারতের উপকূল গুলিতে, বিশেষ করে মালাবার উপকূলে আসত। ভারতীয় ও চীনা পণ্য 'ধাও' নামক বিশেষ জাহাজে করে নিয়ে তারা ইউরোপের বাজারে বিক্রি করত। 712 খ্রিস্টাব্দে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ এর সেনাপতি ও জামাতা মোহাম্মদ বিন কাসেম সিন্ধু দেশে একটি সফল অভিযান করেন এবং সিন্ধুদেশ আরবীয় মুসলমানদের অধীনে চলে যায়। অভিযানের(প্রত্যক্ষ) কারণ ভারতবর্ষের প্রতি আরবদের দীর্ঘদিনের নজর ছিল। এর আগেও বহুবার ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পাঠানো হয়েছিল। তবে এই(712 খৃ:) অভিযানের একটি প্রত্যক্ষ কারণ ছিল। জানা যায় যে সিংহলের রাজা ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কে কয়েকটি জাহাজে করে উপঢৌকন পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু পথে সিন্ধু দেশের জলদস্যুরা দেবল বন্দরে এ...

ষোড়শ শতকীয় ইউরোপে মূল্যবিপ্লব | Price Revolution

 ষোড়শ শতকের ইউরোপে মূল্য বিপ্লব   16 শতাব্দীতে ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলো মূল্য বিপ্লব। নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য প্রায় 150 বছর সুস্থির থাকার পর ঊর্ধ্বমুখী হতে আরম্ভ করে, এবং 16 শতাব্দীর শেষে খাদ্যপণ্যের মূল্যের প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতিতে এমন অভাবনীয় এবং সুদুরপ্রসারী ফলাফলসম্পন্ন ঘটনা মূল্য বিপ্লব নামে পরিচিত। মূল্য বিপ্লবের কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যথা--    (১) কৃষিজ পণ্যের তুলনায় শিল্পজাত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ছিল কম, এবং খাদ্যশস্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। (২) ভূমি রাজস্ব সহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুল্ক, তোলা ইত্যাদির হার বৃদ্ধি এবং ফটকাবাজির আবির্ভাব। (৩) মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় মজুরির হার খুবই কম ছিল বলে প্রকৃত আয় হ্রাস পেয়েছিল। (৪) ভূমি বিক্রয়যোগ্য পণ্যে পরিণত হওয়া। (৫) গ্রামীণ বুর্জোয়াজি শ্রেণীর আবির্ভাব। ষোড়শ শতকের আগেও প্রাকৃতিক কারণে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল, তবে তা ছিল 2, 3 শতাংশের মতো, যা অস্বাভাবিক মনে হতো না। কিন্তু ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যে নিরবিচ্ছিন্ন মূল্যবৃদ্ধি হ...