সুলতানি আমলে ইক্তা ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের বিবর্তনের মধ্যেই ওয়াজদারি ব্যবস্থার অনুপ্রবেশ ঘটে। ইলতুৎমিস প্রথম ইক্তা ব্যবস্থা কে প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে প্রবর্তন করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীনকাল থেকে যে সামন্ত প্রথা চলে আসছিল তা বিলুপ্ত করা এবং কেন্দ্রীয় শাসনের সঙ্গে দূরবর্তী অঞ্চলের যোগসূত্র স্থাপন করা। বলবন ও আলাউদ্দিন খলজি ইকতার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটান। কিন্তু গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ইক্তা ব্যবস্থায় তেমন পরিবর্তন ঘটাননি। আবার মোহাম্মদ বিন তুঘলক ইক্তাকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। কিন্তু ফিরোজ শাহ তুঘলক ইক্তা ব্যবস্থাকে অকার্যকারি করে তোলেন। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে ইক্তার উপর ইজারাদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। এর ফলে ইক্তার মৌল বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু রাজস্ব আদায়কারী ইজারাদারদের সৈন্য ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হতো না। ইজারাদার শর্ত অনুযায়ী সুলতানের প্রাপ্য মিটিয়ে দিতেন। কিন্তু আমিরের সেনারা তার কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য অন্যায় ভাবে চাপ সৃষ্টি করত। কারণ আমিররা সেনা পোষণ দায়িত্ব ছিলেন। এমনকি তথ্যে পাওয়া যায় অনেক ইজারাদার সুলতানের কাছে আমিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পর্যন্ত পেশ করেছিলেন। অবশ্য সাধারণ সৈন্যরা রাষ্ট্রীয় ট্রেজারি থেকে সরাসরি নগদে বেতন পেতো। তবে সর্বনিম্নে "সিপাহশালার" থেকে ঊর্ধ্বে "খান" পদমর্যদার সৈন্যাধক্ষগন কেবল তাদের বেতন বাবদ এক টুকরা ইক্তা ভোগ করতেন। সৈন্যরা দু ভাগে বিভক্ত ছিল, নিয়মিত সৈন্য বাহিনী তাদের বলা হত "ওয়াজিস" অনিয়মিত সৈন্যদের "ঘায়িবওয়াজিস" বলা হত। এই নিয়মিত ও অনিয়মিত সৈন্যদের ফিরোজ শাহ তুঘলকের যে সামান্য খালিশা জমি ছিল তার রাজস্ব থেকে এদের বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এই সৈন্যদের মধ্যে যারা 'ওয়াজ' অর্থাৎ রাজস্ব পেতেন না তাদের "ওয়াজদারি" ব্যবস্থার মাধ্যমে নগদ বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এদের স্থানীয় ট্রেজারি থেকে বেতন দেওয়া হয়।
প্রকৃতপক্ষে "ওয়াজ" শব্দের অর্থ রাজস্ব। গ্রামীণ রাজস্ব বা ওয়াজ যারা পেতেন তাদের ওয়াজদার বলা হত। এবং এই ব্যবস্থাটি ওয়াজদারি ব্যবস্থা নামে খ্যাত। প্রকৃতপক্ষে ওয়াজদারি ব্যবস্থা হল ইক্তার ক্ষুদ্র সংস্করণ। ওয়াজদার উত্তরাধীকারী হিসেবে মনোনীত হতো। কারণ একজন ওয়াজদার এর মৃত্যু হলে তার পুত্র, জামাতা, ক্রীতদাস, এমনকি তার বিধবা স্ত্রীও ওয়াজের অধিকারী হতে পারতেন। ওয়াজদারি ব্যবস্থা রাজস্ব ব্যবস্থায় জটিলতা সৃষ্টি করে। কারণ আলাউদ্দিন যে আধুনিক ও সুবিন্যস্ত রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন তাতে ফিরোজ তুঘলক কর্তৃক ওয়াজদারি ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। রাষ্ট্র ও কৃষকের মাঝে এই ইজারাদারদের আবির্ভাবে কৃষক শোষণ সম্ভবত তীব্র হয়েছিল। সৈনিক ও তাদের প্রকৃত প্রাপ্য না পাওয়ায় সেনাবাহিনীতে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল এবং সৈন্য বাহিনী দুর্বল হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনকালে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন ঘটলেও এই উন্নয়নের উদ্বৃত্ত ফসল হতে কৃষক বঞ্চিত হয়। লাভবান হয়েছিল ইজারাদার তাই বলা হয় ফিরোজ শাহ তুঘলকের প্রবর্তিত ওয়াজদারি ব্যবস্থা তার প্রজার কল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন